ইফতেখার রবিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম শেষে এ দিনে আমাদের দেশ শত্রুমুক্ত হয়। বিজয়ের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। মুক্তিপাগল বাঙালি, বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে সারা পৃথিবীতে যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল-এ দিনটি তারই স্বারক। আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মিলিত শক্তির কাছে পাক হানাদার বাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী এ দিনেই আতসমর্পণ করে। প্রকৃতপক্ষে, এ দিনে পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অস্তিত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। এ দিনটি আমাদের কাছে তাই একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। এ দিবস আমাদের স্বাধীনতার গৌরবকে ধারণ করে আছে। এ দিবসেই আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা পাই। তাই প্রতিবছর এ দিবসে আমরা আত্নসচেতন হই, প্রত্যয়ে দৃপ্ত হই, অস্তরে বিশ্বাস স্থাপন করি-রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতাকে আমরা যেকোনো মূল্যে সমুন্নত রাখবোই। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেওয়া দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আমাদের পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কারণ পূর্ব বাংলার অধিকাংশ লোক ছিল মুসলমান। সুদীর্ঘ দুইশ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার পর তারা মুক্তির স্বপ্ন দেখে। বাঙালি মুসলমানদের কাছে একটি সুবর্ণ সুযোগ আসে দীর্ঘদিনের প্রতারণা ও বঞ্চনা থেকে উদ্ধার লাভের। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমান স্বাধীন দেশ পাকিস্তান লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলার অখন্ডতাকে পরিত্যাগ করে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অংশীদার হয়ে তারা যে মস্তবড় ভুল করেছে, তা তারা শীঘ্রই উপলব্ধি করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানি অর্থাৎ বাংলাভাষী পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের উপর চালায় অত্যাচারের স্টিম রোলার। তারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করে এবং এদেশের মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য করে। এ থেকে এদেশের মানুষের মনে জাগে ঘৃণ্য, জাগে প্রতিবাদ। প্রতিবাদে মুখরিত হয় ছাত্র-জনতা। ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে’- এ দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন-সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, প্রমুখ শহীদেরা। এ থেকে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। স্বাধীকারের সংগ্রামে বাঙালি পরিপক্বতা লাভ করে। ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং এগারো দফার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় ব্যাপক গণজাগরণ। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এরপর মার্শাল’ল দিয়ে ক্ষমতায় আসে ইয়াহিয়া খান। গণআন্দোলনের চাপে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং বাঙালির প্রিয় দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন- এটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু বাধা দেয় পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। শুরু হয় ষড়যন্ত্রের নীল নকশা। ক্রমশ এ ষড়যন্ত্র তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মাঝে বৈঠক হয়। কিন্তু এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অমীমাৎসিত রেখে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো চলে যায়। সেদিন ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সাল। সেই পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতে পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে হানাদার বাহিনী ঢাকা শহরের নিরীহ মানুষের উপর চালায় আক্রমণ। বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যের ট্যাংক হামলায় বিধ্বস্ত হয় সমস্ত নগরী। বঙ্গবন্ধু রাত বারটার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার-ঘোষণা দেন। পরদিন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তদানীন্তন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরপর চলে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পাই আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীন ভূমিতে আমরা উড়াই আমাদের প্রাণপ্রিয় পতাকা। বিজয় দিবস উদযাপন বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মহাসমারোহে এ দিনটি উদযাপন করে। এ দিনে অফিস-আদালত,শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এ দিনে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ পতাকা উত্তোলন করেন এবং কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেন। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বিজয় দিবস পালন করে। বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে এক বর্ণাঢ্য সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মার্চ-পাস্ট এবং মনোরম ডিসপ্লে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সালাম গ্রহণ করেন। শহীদদের আত্নার মাগফেরাত কামনার জন্য প্রার্থনালয়ে দোয়া এবং বিভিন্ন স্থানে কাঙালি ভোজ ও মিলাদের আয়োজন করা হয়। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এ দিনের তাৎপর্যকে তুলে ধরার জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। রেডিও এবং টিভি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। দেশের পত্র-পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকারও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সরকারি ও বেসরকারি ভবনশীর্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও আইল্যান্ডসমূহ জাতীয় পতাকায় সুশোভিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে রাতে আলোকসজ্জা করা হয়। দেশব্যাপী, জেলা ও থানা সদরে পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, স্কাউট, গার্লস গাইড ও বি.এন.সি.সি শরীর চর্চা প্রদর্শন করে। রাজধানী ছাড়াও জেলা ও থানা সদরে ক্রীড়ানুষ্ঠান ও নৌকা-বাইচ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। দেশের বাইরে বাংলাদেশ মিশনগুলোতেও বিজয় দিবস পালিত হয়। এছাড়া দেশের ছাত্র-জনতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে এবং রক্তদান প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছে কত ছাত্র, কত জনতা। জীবন দিয়েছে কত কৃষক, কত শ্রমিক, কত বুদ্ধিজীবী, কত পেশাজীবী মানুষ। বিজয়ের আনন্দের মাঝে জেগে ওঠে তাদেরকে হারানোর বেদনা। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যেন ধারণ করে আছে তাদের স্মৃতি। যে আশা নিয়ে, যে প্রত্যয় নিয়ে তারা মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল-আমরা যেন তা বিস্মৃতি না হই। এ ষোলই ডিসেম্বরে আমাদেরকে তাই শপথ নিতে হবে-লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতাকে আমরা সমুন্নত রাখবোই। আমাদের প্রাণপ্রিয় এ মাতৃভূমিকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলবোই। শোষণমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে। এ দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সে স্বপ্ন আজও বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। দুঃখ-দারিদ্র্য, হতাশা, বঞ্চনা এখনো এদেশের মানুষকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের সংগ্রাম। সে বৈষম্য বেড়ে আজ আরও স্ফীত হয়েছে। অসাধু এবং অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ব্যাহত করছে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। আমাদের সম্ভাবনাময় যুবকরা আজ হতাশাগ্রস্ত। হতাশার অবক্ষয় তাদেরকে তিলে তিলে গ্রাস করছে। লাখ লাখ যুবক আজ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ সন্ত্রাসের শিকার। চাঁদাবাজি, মাস্তানি ইত্যাদি সন্ত্রাসী তৎপরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে সামাজিক অস্থিরতা। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে চালাচ্ছে অপতৎপরতা। স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধ্বংস করার জন্য তারা সদা তৎপর। এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে যে কোনো মূল্যে আমাদের দেশকে উদ্ধার কতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আমরা যদি দেশের উন্নয়ন না করতে পারি, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, তাহলে শহীদদের আত্না আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। মহান বিজয় দিবস শুধু জাতীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন নয়, এটি বাঙালির হৃদয় এবং সত্তার গভীরে প্রোথিত একটি অনন্য দিন। বিজয় দিবস স্বাধীনতাকামী বাঙালির পবিত্র চেতনার ধারক। বাঙালির হাজার বছরের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ইতিহাসে দ্যুতিময় এ দিনটি চিরদিন সমুজ্জলভাবে টিকে থাকবে। আরও পড়ুনবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাবিজয়ের ৫৪ বছরে বাংলাদেশ লেখক: কবি ও শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা কলেজ। কেএসকে/এএসএম