স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা এগিয়েছে বহু বাঁক, সংঘাত ও প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম, সেই সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিল শোষণমুক্ত রাষ্ট্র, নাগরিক মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক শাসনের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা নির্বিঘ্ন থাকেনি। এমনকি স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে এসে প্রশ্ন থেকে যায়— বাংলাদেশ সেই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে?ডিসেম্বর এলেই বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন করে ফিরে আসে দেশবাসীর স্মৃতিতে। স্বাধীনতার মাসে গণতন্ত্রের অর্জন ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা জোরালো হয়। কতটা সুফল পাওয়া গেছে, সেই প্রশ্নের পাশাপাশি সামনে আসে গণতন্ত্র বারবার ব্যাহত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহও। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পথচলার শুরুতেই রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকট গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে জটিল করে তোলে— যার প্রভাব আজও বিদ্যমান।এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমস্যার সূত্রপাত স্বাধীনতার কিছুটা পর থেকেই। তার ভাষায়, “আমরা দেখতে পেয়েছি গণতান্ত্রিক সূচি ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। বিভিন্ন সময় গণতন্ত্র প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রকে একজন রাষ্ট্রপতির শাসনে রূপান্তরিত হতে দেখেছি।”তিনি মনে করেন, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের সময়ই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে পরবর্তী সময়ে একের পর এক রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনকে অনেকেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় বড় ধরনের ছেদ হিসেবে দেখেন। সংসদীয় রাজনীতি কার্যত স্থগিত হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক বহুত্বের জায়গা সংকুচিত হয়। এর পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটে, যা গণতন্ত্রকে আরও দূরে ঠেলে দেয়।সত্তরের দশকের শেষ ভাগে এবং আশির দশকে সামরিক শাসন থেকে বেসামরিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বহুদলীয় রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয় এবং নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতির পুনরাবির্ভাব ঘটে।১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং দেশ আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসে। ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, “১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা গণতন্ত্রের চর্চা দেখতে পেয়েছি। এই সময় নির্বাচন, সংসদ ও সরকারব্যবস্থা কার্যকর ছিল।”তবে তিনি উল্লেখ করেন, এই সময়ের মধ্যেই বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরনের দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যেখানে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রশ্নগুলোতে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। ফলে রাজনীতিতে সংঘাতমূলক সংস্কৃতি আরও গভীর হয়। আরও পড়ুন: ৫৪ বছরে কতটা এগোলো বাংলাদেশ, সামনে কী চ্যালেঞ্জ?নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়, যা একটি সময় পর্যন্ত আস্থার জায়গা তৈরি করেছিল। কিন্তু ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আবারও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। অধ্যাপক মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘‘ওই দুই বছরে আমরা গণতন্ত্রের অবক্ষয় দেখেছি। পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়।‘’তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে; যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। অধ্যাপক মাসুদ হাসানুজ্জামানের বিশ্লেষণে, গত ১৬ বছরে নির্বাচনকে সামনে রেখেই কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একদম হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু ছিল বাংলাদেশে।তার মতে, নির্বাচিত সরকারগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী দমনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ফলে সংসদীয় অসহনশীলতা বেড়েছে এবং গণতন্ত্র চর্চার মৌলিক পূর্বশর্তগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ঘাটতি রয়ে গেছে।এই দীর্ঘ সময়ে সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ না থাকায় বৈষম্য আরও প্রকট হয়। এরই পরিণতিতে ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটে, যেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কার ও ন্যায্য রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি সামনে আসে। ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান মনে করেন, এই অভ্যুত্থান একটি নতুন প্রত্যাশা তৈরি করেছে, সেটি হলো— সংস্কারের মাধ্যমে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা। আরও পড়ুন: ৫৪ বছরে কতটা এগোলো বাংলাদেশ, সামনে কী চ্যালেঞ্জ?তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে যে সংলাপ হয়েছে, তার ফল হিসেবে জুলাই সনদ প্রণীত হয়েছে। এই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন ও গণভোট হওয়ার কথা থাকলেও, এ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য স্পষ্ট।’’তার মতে, ভবিষ্যতে সংস্কার কতটা গণতন্ত্র সহায়ক হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে সামনের নির্বাচন ও গণভোটের ওপর।অধ্যাপক মাসুদ হাসানুজ্জামান সতর্ক করে বলেন, দেশে গণতন্ত্র চর্চার জন্য জাতীয় ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, এই ঐকমত্যের অভাব থাকলে বিদেশি শক্তির প্রভাব বাড়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির ভিন্ন ভিন্ন আন্তর্জাতিক ন্যারেটিভ বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিভক্ত করেছে, যার সুযোগ নিয়ে বিদেশিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে।তার মতে, ২০২৪ পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র চর্চার মূল চ্যালেঞ্জ হলো সংস্কারের বাস্তবায়ন। যদিও পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন এখনও দৃশ্যমান নয়। সংস্কার বাস্তবায়ন কঠিন হলেও, জনগণের মতামত প্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনই ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক পথ নির্ধারণ করবে।