মাত্র ১৮ কাঠা জমি। কিন্তু সেই অল্প জমিতেই ফলছে ২৬ রকমের দেশীয় ও মৌসুমি সবজি। শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবে এমনই এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার পরিশ্রমী কৃষক আবুল কালাম। সীমিত জমিতে পরিকল্পিত ও বহুমুখী সবজি চাষের মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের আর্থিক স্বচ্ছলতাই নিশ্চিত করেননি, বরং এলাকার কৃষকদের জন্য হয়ে উঠেছেন এক অনুকরণীয় উদাহরণ। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ধরে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আবুল কালাম শুরুতে হাইব্রিড জাতের সবজি চাষ করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নানা সমস্যার মুখে পড়েন। অতিরিক্ত রোদ, অনিয়মিত বৃষ্টি, রোগবালাই ও আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় বারবার ফসলের ক্ষতি হতে থাকে। এতে যেমন উৎপাদন খরচ বেড়ে যেত, তেমনি লাভের পরিমাণ কমে আসত। এসব অভিজ্ঞতার পর কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে প্রায় পাঁচ বছর আগে তিনি দেশীয় জাতের সবজি চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বর্তমানে তার ১৮ কাঠা জমিতে একসঙ্গে চাষ হচ্ছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, কলা, লাউ, কুমড়া, করলা, বরবটি, রসুন, পেঁয়াজ, বেগুন, টমেটো, শসা, পালংশাক, পুঁইশাক, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া, মরিচসহ আরও নানা ধরনের দেশীয় সবজি।পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে তিনি বিদেশি সবজি বিটরুটও চাষ করেছেন। জমির প্রতিটি অংশকে সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়ে সারিবদ্ধ ও স্তরভিত্তিক এই চাষ পদ্ধতিতে একই জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। আবুল কালামের এই বহুমুখী চাষ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ঝুঁকি কম থাকা। তিনি জানান, কোনো একটি ফসল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগবালাইয়ের কারণে নষ্ট হলেও অন্য ফসল থেকে সেই ক্ষতি সহজেই পুষিয়ে নেওয়া যায়। চলতি মৌসুমে তার মোট উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত বাজারে সবজি বিক্রি করে আয় করেছেন প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। মৌসুম শেষ হলে এই আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করছেন। তিনি আরও জানান, শুরুতে অনেকেই তার এই পদ্ধতি নিয়ে হাসাহাসি করতেন। কেউ কেউ বলতেন, এত অল্প জমিতে এত রকম সবজি চাষ করে লাভ হবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল দেখে সেই মানুষগুলোর মনোভাব বদলেছে। এখন তারাই এসে জানতে চান কীভাবে তিনি এই চাষ করছেন, কী ধরনের বীজ ব্যবহার করছেন, কীভাবে পরিচর্যা করছেন। স্থানীয় কৃষক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আবুল কালামের জমিতে একসঙ্গে এত রকম সবজি দেখে আমরা খুবই উৎসাহ পাচ্ছি। আগে ভাবতাম, বেশি জমি না হলে ভালো লাভ সম্ভব নয়। এখন বুঝতে পারছি, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে অল্প জমিতেও সফল হওয়া যায়। আমরাও এই পদ্ধতিতে চাষ করতে চাই।’ এই সাফল্যের পেছনে পরিবারের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন আবুল কালাম। তার স্ত্রী সালেহ খাতুন জানান, এই চাষ পদ্ধতির ফলে শুধু আর্থিক লাভই হয়নি, বরং সারাবছর পরিবারের জন্য টাটকা ও বিষমুক্ত সবজির যোগান নিশ্চিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নিজেদের চাষ করা সবজি আমরা নিজেরা খাচ্ছি, আবার বিক্রি করেও সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। এতে পরিবারের খরচ কমেছে, আয় বেড়েছে।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সঞ্জয় মিধা বলেন, ‘আবুল কালামের এই উদ্যোগ প্রান্তিক কৃষকদের জন্য একটি কার্যকর মডেল। সীমিত জমিতে বহুমুখী সবজি চাষের মাধ্যমে কীভাবে আয় বাড়ানো যায়, আবুল কালাম তার বাস্তব উদাহরণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই মডেলটি আরও ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে, যাতে অন্য কৃষকরাও উদ্বুদ্ধ হন এবং নিজেদের জীবিকায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন,‘বর্তমান সময়ে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এমন বহুমুখী ও পরিকল্পিত চাষ পদ্ধতি কৃষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে একদিকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, অন্যদিকে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায়। আবুল কালামের সাফল্য প্রমাণ করছে সঠিক সিদ্ধান্ত, পরিশ্রম ও আধুনিক কৃষি ভাবনা থাকলে অল্প জমিতেও সম্ভব বড় সাফল্য অর্জন করা।’ আরও পড়ুনফেনীতে আমনের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসিপরিবেশ রক্ষায় সময়ের অপরিহার্য আহ্বান আসিফ ইকবাল/কেএসকে/