রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরের লালমাটিয়া এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই বদলে যায় চিত্র। রাস্তার দুই পাশেই দেখা মেলে সারি সারি পুরোনো ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্যের দোকান। বিকাল থেকে অস্থায়ীভাবে বসতে শুরু করা এসব দোকানে পুরোনো নানা ধরনের যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম কেনাবেচা হয়, যা ক্রেতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকাল গড়াতেই রাস্তার পাশে অস্থায়ীভাবে দোকান বসাতে শুরু করেন বিক্রেতারা। সন্ধ্যার মধ্যেই পুরো এলাকায় গড়ে ওঠে অনেক অস্থায়ী দোকান। এসব দোকানে একদিকে যেমন পুরোনো যন্ত্রপাতি কেনাবেচা হয়, অন্যদিকে তেমনি চলে মেরামতের কাজও। আলো-ঝলমলে দোকান, সারি সারি যন্ত্রাংশ আর ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষির শব্দে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। বিকাল থেকে অস্থায়ীভাবে বসতে শুরু করা এসব দোকান এই বাজারে পাওয়া যায় পুরোনো ও ব্যবহৃত টিভি, ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার সামগ্রী, সার্কিট, মোটর, ব্যাটারি, সুইচ, সকেট, এলইডি লাইটসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যালের যন্ত্রাংশ। বিশেষ করে প্রকৌশল শিক্ষার্থী ও টেকনিক্যাল কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় অনেক সরঞ্জাম এখানে তুলনামূলক কম দামে মিলছে। সন্ধ্যার পর থেকেই দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে থাকে। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখানে আসেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। দামে তুলনামূলক কম হওয়ায় সাধারণ পরিবারের সদস্য ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ে। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে এই হাট। বিশেষ করে শুক্রবার ছুটির দিন ভিড় বেশি হয়। মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা শাকিল আহম্মেদ। কাছে থাকার সুবিধায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি আসেন পুরোনো মালামালের এই বাজারে। এখানে এসে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাই নয়, বরং পুরোনো জিনিসের ভেতর লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাই তাকে টানে বারবার। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখানে আসেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে শাকিল আহম্মেদ জানান, বাজার থেকে তিনি নিজের ও পরিবারের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে থাকেন। পাশাপাশি একটু ভিন্নধর্মী বা ইউনিক কোনো জিনিস চোখে পড়লে তা সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে যেসব জিনিস মানুষের আগ্রহ তৈরি করতে পারে, সেগুলোর দিকেই থাকে তার আলাদা নজর। তিনি বলেন, ‘এসব পুরোনো জিনিস বাসায় নিয়ে গিয়ে নিজেই মেরামত ও পরিষ্কার করি। ব্যবহারযোগ্য করে তোলার পর সেগুলো অনলাইনে ভালো দামে বিক্রি করি। এতে একদিকে যেমন নিজের প্রয়োজন মেটে, অন্যদিকে বাড়তি আয়ের সুযোগও তৈরি হয়।’ তার মতো তরুণদের এই ধরনের উদ্যোগ প্রমাণ করে, সচেতনতা ও সৃজনশীলতা থাকলে পুরোনো মালামালের বাজারও হতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন ঠিকানা। পুরোনো ও ব্যবহৃত টিভি, ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার সামগ্রী, সার্কিট, মোটর, ব্যাটারি, সুইচসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যালের যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় এখানে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার শান্ত ইসলাম বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। চাকরির ব্যস্ততার মাঝেও প্রযুক্তির প্রতি তার আগ্রহ থেমে নেই। সময় পেলেই তিনি ছুটে আসেন পুরোনো মালামালের বাজারে, যেখানে তার চোখে পরিত্যক্ত জিনিস নয়, বরং লুকিয়ে থাকে নতুন সম্ভাবনা। শান্ত ইসলাম জানান, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য তিনি মাঝেমধ্যে এই বাজার থেকে পুরোনো মালামাল সংগ্রহ করেন। এসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেই তিনি দুটি পাওয়ার সাপ্লাই, একটি স্পিকার এবং একটি স্ক্রু-ড্রাইভার তৈরি করছেন। তিনি বলেন, ‘পুরোনো মালামাল ব্যবহার করে কাজ করলে একদিকে যেমন খরচ কমে, অন্যদিকে অপচয়ও রোধ হয়। অনেক সময় যেগুলো অচল মনে হয়, সঠিক জ্ঞান ও যত্নে সেগুলো আবার ব্যবহারযোগ্য গড়ে তোলা সম্ভব।’ প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে এখানে শান্ত ইসলামের মতে, এই ধরনের উদ্যোগ তরুণদের প্রযুক্তিমুখী হতে উৎসাহিত করতে পারে। তার বিশ্বাস, সৃষ্টিশীলতা আর দক্ষতার সমন্বয় থাকলে পরিত্যক্ত জিনিসও হয়ে উঠতে পারে নতুন উদ্ভাবনের ভিত্তি। একটি ভ্যানে পুরোনো মালামাল বিক্রি করছে এক কিশোর। ক্রেতাদের সঙ্গে সে খুব সুন্দরভাবে কথাও বলছে এবং তাদের প্রয়োজনমতো মালামাল দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে দোকানের জিনিসপত্র মুছে মুছে সাজিয়ে রাখছে। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, তার নাম রমজান। বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়াশোনার পাশাপাশি সে এই দোকান পরিচালনা করছে। রমজান জানায়, তার বাবা ২০০৮ সাল থেকে এই ব্যবসা করছেন। ছোট একটি দোকান দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে তাদের দুটি দোকান রয়েছে। একটি দোকান পরিচালনা করেন তার বাবা, আর অন্যটিতে বসে রমজান। বাবার সঙ্গে ২০১৪ সাল থেকে সে দোকানে কাজ শুরু করেছিল, কিন্তু মাত্র তিন মাস আগে থেকে নিজের দোকানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সামলাচ্ছে এই কিশোর। অনেক মানুষও নষ্ট বা আংশিক ভালো পুরোনো মালামাল দোকানেও বিক্রি করতে নিয়ে আসেন রমজান বলেন, ‘মিরপুর এক নম্বর ও গুলিস্তান এলাকা থেকে পুরোনো মালামাল সংগ্রহ করে। এসব মালামালের মধ্যে অনেকগুলো নষ্ট থাকে, যা পরে বিভিন্ন উপায়ে মেরামত করে বিক্রির উপযোগী করি। এছাড়া স্থানীয়ভাবে অনেক মানুষও নষ্ট বা আংশিক ভালো পুরোনো মালামাল দোকানেও বিক্রি করতে নিয়ে আসেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘মালামালের কোয়ালিটি ও ধরণ হিসেবে বিভিন্ন রকমের দাম হয়। এখানে ১০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকার ওপরেও জিনিসপত্র পাওয়া যায়। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানে বসি। তবে সন্ধ্যার পর থেকে ভিড় বাড়তে থাকে। প্রতিদিন দৈনিক গড়ে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকার বিক্রি হয়। ছুটির দিনে, বিশেষ করে শুক্রবারে, বিক্রি সবচেয়ে বেশি হয়।’ আরও পড়ুনগ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিয়ের আয়োজন কি হারাতে বসেছেসাদা মরুভূমি অ্যান্টার্কটিকা: শীতের চরম বাস্তবতা কেএসকে/