পোশাক খাত: পাঁচ দশকের পরিক্রমা, আগামীর দিন কেমন হবে?

একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতির ভরসা বা প্রাণকেন্দ্র ছিল পাট। ‘সোনালি আশ’ নামে পরিচিত এই কৃষিপণ্যই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান ভরসা। গ্রাম থেকে বন্দর-সারা দেশজুড়ে পাটের চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানি ঘিরেই আবর্তিত হতো অর্থনীতি। কিন্তু সময় বদলেছে। বৈশ্বিক চাহিদা, প্রযুক্তির পরিবর্তন আর নীতিগত দুর্বলতায় ধীরে ধীরে সেই সোনালি আশের উজ্জ্বলতা ফিকে হয়েছে। ঠিক সেই শূন্যস্থানেই উঠে এসেছে তৈরি পোশাক খাত; যা আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি, সবচেয়ে বড় রফতানি খাত এবং লাখো মানুষের জীবিকার মূল ভরসাস্থল।পাট থেকে পোশাকে এই উত্তরণ কেবল একটি খাতের উত্থান নয়; এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের গল্প। স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যে দেশটি টিকে থাকার লড়াই শুরু করেছিল, পাঁচ দশকের ব্যবধানে সেই দেশ আজ বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক। এই দীর্ঘ পথচলায় আছে সাফল্যের গল্প, আছে সংকটের বাস্তবতা আর অনিশ্চিত আগামীর কঠিন চ্যালেঞ্জ। পোশাক খাতের উত্থান: শূন্য থেকে সম্ভাবনায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সে সময় রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা, পাটকল ও সীমিত কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বাইরে বড় কোনো রফতানি খাত গড়ে ওঠেনি। তবে তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ তকমা শুধু উৎপাদনের পরিচয় নয়; এটি বিশ্ববাজারে দেশের মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক। যে বাংলাদেশকে একসময় নিন্দুকরা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলত, আজ সেটি ‘বিস্ময়ে ভরা ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত। আরও পড়ুন: ৫৪ বছরে কতটা এগোলো বাংলাদেশ, সামনে কী চ্যালেঞ্জ? আর এই প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশের জোগান দিয়ে থাকে। বর্তমানে চীনের পরে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক। মূলত আশির দশকে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে উৎপাদন ব্যয় কমানোর প্রবণতা শুরু হলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নজরে আসে। স্বল্প মজুরি, বিপুল শ্রমশক্তি এবং শুল্ক-কোটা সুবিধা তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থানে সহায়ক হয়। শুরুটা যেভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রথম তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন প্রথমবারের মতো ফ্রান্সে মাত্র ১০ হাজার পিস শার্ট রফতানি করেন। ক্রেতা ছিলেন ফরাসি হ্যান্ডলার ফ্রঁস। চালানের মোট মূল্য ফরাসি মুদ্রায় ছিল মাত্র ১৩ মিলিয়ন ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) মতে, প্রয়াত নূরুল কাদের খান ছিলেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের পথিকৃৎ। ১৯৭৮ সালে তিনি ১৩০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তারা তৈরি পোশাক উৎপাদন শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর, তিনি দেশের প্রথম রফতানি পোশাক কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ে বন্ড গার্মেন্টসের মরহুম আখতার মোহাম্মদ মুসা, রিয়াজ গার্মেন্টসের মরহুম মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, প্যারিস গার্মেন্টসের মো. হুমায়ুন, আজিম গ্রুপের ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ফজলুল আজিম, সানম্যান গ্রুপের মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান, স্টাইলক্রাফ্ট লিমিটেডের এম শামসুর রহমান এবং অ্যারিস্টোক্র্যাট লিমিটেডের এএম সুবিদ আলীও দেশীয় পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। কয়েকটি কারখানা, সীমিত অর্ডার আর পরীক্ষামূলক রফতানি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সাহসী বিনিয়োগ, শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মিলিয়ে পোশাক শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ করে। নব্বইয়ের দশক পেরিয়ে দুই হাজারের পর তৈরি পোশাক হয়ে ওঠে দেশের প্রধান রফতানি খাত। বদলেছে সমাজের চিত্র, বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা এই শিল্প শুধু বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ায়নি; বদলে দিয়েছে সমাজের চিত্রও। এ খাত একদিকে যেমন কোটি কোটি ডলার রফতানি আয় এনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তেমনি সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কয়েক কোটি মানুষের জীবিকাকে যুক্ত করছে। গ্রাম থেকে শহরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের জন্য। লাখ লাখ নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় প্রভাব রয়েছে নারীর কর্মসংস্থানে। তৈরি পোশাক খাতে নারী কর্মসংস্থান শুধু চাকরি নয়, এটি নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালক। এতে অল্পবয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ কমেছে, শিশু মাতৃত্ব হ্রাস পেয়েছে। পোশাক খাত সরাসরি দেশের সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। নারী শ্রমিকরা উপার্জিত অর্থ গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। বিজিএমইএর পরিসংখ্যান বলছে, সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের; যা ওই অর্থবছরের মোট রফতানি আয়ের ৮১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল রেকর্ড ৪ হাজার ২৬১ কোটি ৩১ লাখ ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক। সবুজ বিপ্লবের পথে দেশের পোশাক শিল্প দেশের পোশাক শিল্প আর অর্থনীতিতে পরিবর্তন-উত্তরণে গতি এসেছিল ঠিক ১২ বছর আগে; ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। ওই দিন সকালেই ধসে পড়েছিল সাভারের রানা প্লাজা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ওই শিল্প দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কর্মরত ১ হাজার ১৩৮ জন পোশাক শ্রমিক। দীর্ঘদিনের উদ্ধারকাজ শেষে আহত শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় আড়াই হাজার। এর রেশ ধরেই মার্কিন বাজারে স্থগিত হয় জিএসপি সুবিধা। তবে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের চাপ ও পরামর্শে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ। এরপর গত এক দশকে বাংলাদেশের পোশাক খাতে হয়েছে সবুজ বিপ্লব। বর্তমানে বিশ্বসেরাসহ ১০০টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৬৮টিই বাংলাদেশের। আবার প্রথম ২০টির মধ্যে ১৮টি। এই সবুজ বিপ্লবে শুধু প্রকৃতির নিরাপত্তা নিশ্চিতই নয়, নিরাপদ হয়েছে পোশাকশ্রমিকদের কর্মপরিবেশও। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) এখন পর্যন্ত দেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ২৬৮টি কারখানাকে লিড সনদ দিয়েছে। এর মধ্যে লিড প্লাটিনাম ১১৪টি, লিড গোল্ড ১৩৫টি, লিড সিলভার ১৫টি ও সার্টিফায়েড ৪টি। আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা ১০০ পরিবেশবান্ধব কারখানার ৬৮টিই বাংলাদেশের: বিজিএমইএ অর্থনীতিবিদদের মতে, আগামীর বিশ্ববাজার দখলে প্রতিযোগিতা চলবে সবুজকে ঘিরে। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, বিশ্ববাজার দখলের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে পরিবেশবান্ধব এই কারখানাগুলো। এই অর্জনকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশে সবুজ কারখানায় তৈরি পোশাকের জন্য আলাদা ট্যাগ বা ব্র্যান্ড তৈরি করা উচিত, যাতে তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয় এবং অতিরিক্ত অর্ডার পেতে সাহায্য করে। এছাড়া ট্যাক্স বা ট্যারিফের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়ার মতো প্রণোদনা চিন্তা করা যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি: অর্জনের পাশাপাশি চাপ পোশাক শিল্পের এই সাফল্যের আড়ালে রয়েছে নানামুখী সংকটও। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অনিয়মিত সরবরাহ উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডলারের সংকট ও বিনিময় হারের অস্থিরতায় কাঁচামাল আমদানি এবং এলসি খুলতে গিয়ে কারখানাগুলো চাপে পড়ছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা অনেক সময় সময়মতো অর্ডার বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চাপ কম নয়। ক্রেতারা একদিকে কম দামে পণ্য চান, অন্যদিকে উচ্চমানের কমপ্লায়েন্স ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। মজুরি বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের ফলে উৎপাদন খরচ বাড়লেও সেই অনুযায়ী পণ্যের দাম বাড়ছে না-এটাই এখন উদ্যোক্তাদের বড় অভিযোগ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি সালেউদ জামান খান বলেন, বর্তমানে যে পণ্যগুলো আমরা তৈরি করছি, সেখানে ভ্যালু এডিশন খুব কম। আমাদের লক্ষ্য ছিল অনেক আপগ্রেড প্রোডাক্ট তৈরি করা, কিন্তু আমরা অনেক নিচে নেমেছি। আমরা শুধু মজুরি দিয়ে পণ্য তৈরি করছি। সুতা, কাপড়, ডায়িংসহ প্রতিটি ধাপই বাংলাদেশে হতে হবে; না হলে খাতের মেরুদন্ড সোজা হবে না। যে কোনো সময় এসব অর্ডারও হারাতে পারে বাংলাদেশ। বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, গত কয়েক মাসে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি ও আন্তর্জাতিক ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি, স্থানীয় রাজনৈতিক সাপোর্টের অভাব এবং ব্যাংকের সীমিত সক্ষমতা বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। ব্যাংকগুলোতে তহবিল সংকট এবং অনুপযুক্ত সাপোর্টের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানি বাজার সম্প্রসারণে ১৯৮৯ সালে গঠিত হওয়া রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার আরও কমিয়ে সর্বোচ্চ ২ বিলিয়ন ডলারে নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি কার্যকর থাকবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই তহবিলের অর্থে উদ্যোক্তারা বহুমুখী পণ্য তৈরিতে এলসি খোলাসহ বিশেষ সুবিধা পেতেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। করোনা মহামারিকালীন ২০২০ সালে ইডিএফের আকার ছিল ৭ বিলিয়ন ডলার। পরের তিন বছরে তহবিলের পরিমাণ কমে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন ডলারে। বিজিএমইএ'র পরিচালক রশিদ আহমেদ হোসাইনী বলেন, ‘পোশাকখাত থেকে প্রণোদনা প্রায় তুলেই নেয়া হয়েছে। যেটি আছে, সেটিও নামমাত্র। ইডিএফও তেমনই অবস্থায় রয়েছে। এতে অনেক কারখানার ঝুঁকি বেড়ে গেছে।’ শ্রমিকদের দিক থেকেও বাস্তবতা কঠিন। ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সেই স্বস্তি অনেকটাই কেড়ে নিচ্ছে। বেতন-ভাতা, কর্মঘণ্টা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ পুরোপুরি কাটেনি। নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও নিরাপত্তা প্রশ্নও এখনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। শ্রম আইন সংশোধন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংশোধন চেয়ে আসছিল জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা (আইএলও), যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো। বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ করা, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় শ্রম আইন কার্যকর করাসহ শ্রম অধিকার-সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বিষয়ে চাপ ছিল বাংলাদেশের ওপর। অবশেষে ১৭ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫‘ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। তবে নতুন শ্রম আইন নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। মালিকপক্ষের অভিযোগ, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পরে তা পরিবর্তন করা হয়েছে এবং নতুন আইন তাদের ভাষায় মালিকদের ‘জিম্মি’ করে ফেলছে। এতে যে কোনো সময় তৈরি পোশাকসহ রফতানি খাতে অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। উদ্যোক্তাদের দাবি, নতুন আইন শিল্পে অস্থিরতা বাড়াবে। বিজিএমইএর পরিচালক রশিদ আহমেদ হোসাইনী বলেন, যে শ্রম আইন পাস হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের বাস্তবতা, দেশের অর্থনীতি ও শিল্পের প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী হয়নি।  আরও পড়ুন: ইডিএফ কমানোর সিদ্ধান্ত সরকারের, কী বলছেন উদ্যোক্তারা? বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন,আগামী দিনগুলোতে এই খাতকে ‘কন্টিনিউয়াসলি সাফার’ করতে হবে। যারা এই আইনটি করিয়েছে, তারা পরিকল্পিতভাবেই করিয়েছে। বহুবার উদ্বেগ জানানো হলেও সরকার আইনটি পরিবর্তন করেনি। অন্যদিকে শ্রমিকরা বলছেন, সংশোধিত শ্রম আইনটি কর্মীবান্ধব হয়েছে। নতুন শ্রম আইন তাদের জন্য তুলনামূলকভাবে সহায়ক এবং এতে সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য তাসলিমা আখতার বলেন, যা কিছু চেয়েছি, সব পাওয়া যায়নি। তবে শ্রম আইনে যা হয়েছে, সেটি গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষারই ফলাফল। ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, ‘শ্রমিকের সংজ্ঞা শ্রমিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তারা আইন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবে। প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি মানতে হবে, আর না মানলে শাস্তির ব্যবস্থাও থাকতে হবে। নতুন আইন বাস্তবায়নে শিল্পাঞ্চলগুলোতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, গত ১৫–১৬ মাসে তৈরি পোশাক ও রফতানি খাতে শ্রমিক অসন্তোষ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং শিল্পাঞ্চলে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা গেছে। শ্রমিক আন্দোলন বর্তমানে কিছুটা সীমিত থাকলেও ভবিষ্যতে আবার তা মাথাচাড়া দিতে পারে। কারণ, একটি কারখানায় সমস্যা তৈরি হলে তা দ্রুত আশপাশের কারখানাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে এবং বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তবে শ্রম আইনকে পুঁজি করে যাতে কেউ দেশের ক্ষতি করতে না পারে এবং শিল্পকারখানা বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বিঘ্ন না ঘটে-সেদিকে নজর দেয়ার তাগিদও দিয়েছেন তিনি। ড. কবির বলেন, নতুন শ্রম আইন প্রণয়ন হলেও সেটির কার্যকর বাস্তবায়নে সময় লাগবে। সব কারখানা নতুন এই আইন মেনে চলছে কি না, সেটিও নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। একইসঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার ও কমপ্লায়েন্স কঠোরভাবে মানতে হবে। এলডিসি উত্তরণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য সামনে বড় এক মোড় হলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ। একদিকে এটি অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্বীকৃতি, অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এলডিসি সুবিধা হারালে শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশের সুযোগ কমে যাবে, ফলে রফতানির খরচ বাড়বে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের জায়গা। ইউরোপীয় বাজারে তুলনামূলক সুবিধা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্ক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিযোগিতায় বাধা হয়ে আছে। ভবিষ্যতে এই শুল্কনীতি আরও কঠোর হলে রফতানি ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন,মার্কিন ট্যারিফ নীতির কারণে শুরুতে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবে পূরণ হয়নি। মূলত ট্রাম্পের বিশ্বব্যাপী ট্যারিফের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে পণ্য ক্রয়ের চাহিদা কমে যায়। ট্রাম্পের ট্যারিফ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের রফতানিতেও। এর পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ নতুন করে তৈরি পোশাক বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করছে। আধুনিক প্রযুক্তি, দ্রুত ডেলিভারি ও নীতি সহায়তার কারণে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে। এদিকে টানা চার মাস ধরে দেশের রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সেখানে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। তবে শুধু পোশাক নয়, পাট ও টেক্সটাইলসহ অন্যান্য খাত এবং হিমায়িত খাদ্যের মতো প্রধান রফতানি পণ্যেও মন্দাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন ড. মাহফুজ কবির। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে দেশি-বিদেশি বিপুল বিনিয়োগ এবং বিপুল কর্মসংস্থান জড়িত। কিন্তু উচ্চ সুদের হারে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হওয়ায় উদ্যোক্তারা বড় ধরনের চাপে রয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রফতানিতে অনিশ্চয়তা, যা মালিক, শ্রমিক-সবার জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: সংকটের মাঝেও আলো সব সংকটের মধ্যেও তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অন্ধকার নয়। বরং সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিগত সহায়তা পেলে এই খাত আরও পরিণত রূপ নিতে পারে। কম দামের বেসিক পোশাকের বাইরে উচ্চমূল্যের, ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্য উৎপাদনে যাওয়ার সুযোগ এখনো রয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, ডিজাইন সক্ষমতা এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুললে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্ত হতে পারে। নতুন বাজার অনুসন্ধানও গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে ধীরে ধীরে প্রবেশ বাড়ানো গেলে ইউরোপ ও আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কমবে। একই সঙ্গে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ালে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখা সহজ হবে। আরও পড়ুন: রফতানিতে এফওসি সুবিধা বাড়ালে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হওয়ার শঙ্কা! ফজলে শামীম এহসান বলেন, গার্মেন্টস খাতে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ও নতুন যন্ত্রপাতি অপর্যাপ্ত। ব্যাংক এবং সরকারের উদ্ভাবনী ফান্ড থাকলেও তা সহজলভ্য নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মূলত কয়েকটি প্রধান আইটেমের উপর নির্ভরশীল; পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ তেমন একটা হয়নি। ফলে নতুন বাজার ধরতে এবং বৈচিত্রপূর্ণ রফতানি বাড়াতে বাধা তৈরি হয়েছে। নতুন আইটেম তৈরি করতে সরকারী সাপোর্ট, মেশিনারিজ ও নীতি সহজী করা জরুরি। যদি প্রযুক্তিগত এবং ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্ট বৃদ্ধি পায়, নতুন প্রোডাক্ট তৈরি এবং গুণগত মান বাড়ানো সম্ভব। ড. মাহফুজ কবিরের মতে রফতানিকারকরা আশা করছেন, নির্বাচিত নতুন সরকার অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেবে। এর ফলে রফতানি খাত ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে। তৈরি পোশাক খাতে আরও কাজ করতে হবে-পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে, নতুন বাজার তৈরি করতে হবে এবং ফাইবারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নতুন বাজার দখল করতে ডিপ্লোম্যাটিক মিশনগুলোর কমার্শিয়াল উইংগুলোর সক্রিয়তা জরুরি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়, তবে রফতানি খাতে নতুন গতি আসবে এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি আরও বাড়বে। দেশের তৈরি পোশাক খাত বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা, এলডিসি উত্তরণ, শুল্কনীতি ও অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আরও শক্তিশালী হতে প্রয়োজন সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ সহায়তা। এছাড়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজার সম্প্রসারণ ও রফতানি বহুমুখীকরণ বদলে দিতে পারে এ খাতের চেহারা। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং সরকারি ও বেসরকারি সমর্থন মিলিয়ে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের বিশ্ববাজারে আরও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দেয়া সম্ভব বলে মত বিশেষজ্ঞদের।