একাত্তরের রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীর নির্দিষ্ট পোশাক থাকার পরেও দাড়ি-টুপি দিয়ে তাদের চিত্রিত করার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি বলে জানিয়েছে সাধারণ আলেম সমাজ। আলেম সমাজকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজাকার বা শত্রুর প্রতীকে উপস্থাপনের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে উল্লেখ করে তারা বলছেন, এতে ঐতিহাসিক সত্যের চরম বিকৃতি ঘটছে।বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) সাধারণ আলেম সমাজের মুখপাত্র আবদুল্লাহ আল মাসউদ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সংকটময় সময়ে আলেম সমাজ মসজিদের মিম্বরে ইনসাফের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। জালেম শাসকের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণের সাহসিকতা দেখিয়ে আলেমরা জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের মুক্তিকামী সংগ্রাম বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরাধীন দেশে জুমার নামাজ আদায় করা যাবে না—এমন ঘোষণা দিয়ে খতিবগণ নামাজ না পড়ানোর মতো কঠিন ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো পরিণত হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর অঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্রে। এরই প্রতিক্রিয়ায় পাক হানাদার বাহিনী অসংখ্য মাদ্রাসা সিলগালা করে এবং আলেমদের ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন। তৎকালীন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অভিভাবক হিসেবে জাতীয় বিবেক আলেম সমাজের এই দৃঢ়, আপসহীন ও নৈতিক অবস্থানের কারণেই দেশের মুক্তিকামী জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আলেম সমাজ কখনোই জালেমের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। সব সময় ইনসাফ, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থেকেছে। আরও পড়ুন: দাড়ি-টুপিকে রাজাকারের প্রতীক বানানোর নিন্দা হেফাজতে ইসলামের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অথচ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, ৫৪ বছর আগে যারা স্বাধীনতার চেতনাকে হাইজ্যাক করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল, তারা আজও বিভিন্ন রূপ ও কৌশলে তৎপর। সেক্যুলারিজমের দোহাই দিয়ে একটি ধর্মীয় পোশাককে রাজাকারের ‘ট্রেডমার্ক’ হিসেবে দেখিয়ে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। আলেম সমাজ অভিযোগ করেন, ইসলামের বিধান, মুসলমানদের পরিচয়, দাড়ি-টুপি এবং আলেম সমাজকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজাকার বা শত্রুর প্রতীকে উপস্থাপনের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এতে ঐতিহাসিক সত্যের চরম বিকৃতি ঘটছে। আর্কাইভাল ফুটেজ এবং ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামরিক বা আধা-সামরিক ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। দাড়ি-টুপি বা নির্দিষ্ট ধর্মীয় পোশাক রাজাকারদের কোনো ‘অফিসিয়াল ইউনিফর্ম’ ছিল না। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে আড়াল করে কেবল ধর্মীয় লেবাসকে রাজাকারের সমার্থক করে তোলা ইতিহাসের একটি খণ্ডিত ও পক্ষপাতমূলক উপস্থাপনা। সুতরাং এটি সাধারণ কোনো মতপ্রকাশ নয়, বরং আজাদির সিলসিলায় গড়ে ওঠা সহাবস্থানের দেশ ও জাতিকে বিভাজিত করার সুপরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্র। আরও পড়ুন: মানুষ আওয়ামী লীগকেই এখন রাজাকার মনে করে: উপদেষ্টা ফারুকী বিজ্ঞপ্তিতে ভারতীয় বয়ান টিকিয়ে রাখার মধ্যদিয়ে পাকিস্থানপন্থি বয়ানকেও প্রাসঙ্গিক রাখা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আলেম সমাজ। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করতে চাই, ৫৪ বছর আগে যারা আমাদের শত্রু ছিল, তারা আজও আমাদের শত্রু। সময়ের প্রয়োজনে রূপ ও ভাষা পরিবর্তিত হলেও শত্রুতার মৌলিক চরিত্র অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই একাত্তরের প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্থানপন্থি কিংবা আধিপত্যবাদী শক্তির হোলসেলার আওয়ামী বয়ান গেলানোর সুযোগ নেই। একাত্তরকে ব্লাসফেমিতে পরিণত করার প্রকল্পকে যারা এতদিন পেট্রোনাইজ করেছে, তারাই মূলত আধিপত্যবাদ ও মুজিববাদের দালাল। ভারতীয় বয়ানে একাত্তর মানেই পাকিস্থানপন্থি বয়ানকে প্রাসঙ্গিক রাখা। সুতরাং আমরা দুই বয়ানকেই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের উচিত ৪৭, ৭১ ও ২৪ এর এ আজাদির সঠিক ও নির্মোহ বাংলাদেশপন্থার ইতিহাস পুনর্পাঠ করা।