দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্প বিকাশে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড। রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে একসঙ্গে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০টি জাহাজ নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাহাজ হস্তান্তরের পাশাপাশি ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে জাহাজ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।সরেজমিনে শিপইয়ার্ডের বিস্তীর্ণ ডক এলাকায় দেখা যায়, নির্মাণাধীন একাধিক জাহাজ। কোথাও লোহার পাত জোড়া লাগানোর শব্দ, কোথাও ওয়েল্ডিংয়ের ঝলক, সব মিলিয়ে দিনরাত কর্মচাঞ্চল্যে মুখর খুলনা শিপইয়ার্ড। বর্তমানে এখানে নির্মাণাধীন জাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধ জাহাজ, মোংলা বন্দরের একটি রেসকিউ ভেসেল, পায়রা বন্দরের দুটি টাগ বোট, একটি সার্ভে ভেসেল ও একটি পাইলট ভেসেল। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য নির্মিত হচ্ছে ১২টি ড্রেজার ও জিআরপি ক্যাটামারান বোট। সব জাহাজ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হস্তান্তরের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও পড়ুন: আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য জব্দের জেরে হামলা, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা এই কর্মযজ্ঞে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার ২০০ শ্রমিক। ওয়েল্ডার, ফিটার, রং ও যন্ত্রাংশ স্থাপনসহ নানা কাজে নিয়োজিত এসব শ্রমিক নিয়মিত কাজ, নিরাপদ পরিবেশ ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ পাচ্ছেন। উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. কামরুল ইসলাম বলেন, খুলনা শিপইয়ার্ড দিনে দিনে অনেক উন্নতি করছে। প্রতিদিন আমরা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছি। এখানকার শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারা নিয়মিত বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পায়। শ্রমিক মো. আল আমিন বলেন, নিয়মিত কাজ পাই এবং সময়মতো বেতন দেয়া হয়। বড় বড় জাহাজে কাজ করার ফলে আমাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দুটোই বাড়ছে। আগে কাজ অনিশ্চিত ছিল। এখন দীর্ঘমেয়াদি কাজ থাকায় পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তে চলতে পারছি। ওয়েল্ডার হিসেবে কর্মরত মো. রাশেদ হোসেন বলেন, নিরাপত্তা সরঞ্জাম দিয়ে কাজ করতে পারি। নিয়মিত প্রশিক্ষণ থাকায় কাজের মান ভালো হচ্ছে, ঝুঁকিও কমছে। শিপইয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়মতো মানসম্মত জাহাজ নির্মাণ ও হস্তান্তরের কারণেই দিন দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আস্থা বাড়ছে খুলনা শিপইয়ার্ডের প্রতি। খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (ডিজাইন অ্যান্ড প্ল্যানিং) ক্যাপ্টেন এএফএম এনামুল হোসেন বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মানসম্মত জাহাজ নির্মাণ নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। একসঙ্গে এতগুলো জাহাজ নির্মাণ চলছে এখানে, তার মানে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আস্থা বাড়ছ প্রতিনিয়ত।’ আরও পড়ুন: বহির্বিশ্বে সমুদ্র বাণিজ্যে ভাগ বসাতে ২২টি মাদার ভেসেল কেনার পরিকল্পনায় বিএসসি এদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মো. শহীদুল্লাহ আল ফারুক জানান, ‘ভবিষ্যতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য আরও বড় আকারের জাহাজ নির্মাণে এগোতে চায় খুলনা শিপইয়ার্ড। ধারাবাহিকভাবে খুলনা শিপইয়ার্ড উন্নতি করে চলেছে। এই উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখাই আমাদের লক্ষ্য। এটা করতে পারলে আমরা বাংলাদেশে নৌ-বাহিনী, কোস্ট গার্ডের যে প্রয়োজন আছে বিদেশ থেকে যুদ্ধ জাহাজ আমদানি, নির্মাণ সেটার আর প্রয়োজন হবে না।’ অন্তত মাঝারি আকারের জাহাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আর বিদেশ নির্ভর হতে হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যতে এই শিপইয়ার্ডকে আন্তর্জাতিক মানে নেয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের এখানে তৈরি জাহাজ অন্য যে কোনো দেশের থেকে মান সম্মত।’ ১৯৫৭ সালে ৬৯ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড এখন পর্যন্ত ৮ শতাধিক জাহাজ নির্মাণ করেছে। এক সময় লোকসানে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৯ সালে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে লাভের ধারায় ফিরে আসে। সবশেষ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। শিল্প খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুলনা শিপইয়ার্ডের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে, দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশ আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।