‘বডি কন্ট্রাক্টে’ মানবপাচার, গোয়েন্দা তথ্যে দুই কর্মকর্তার নাম

এইচএসসি পাসের সনদে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন মিজানুর রহমান শিশির। কয়েক বছর পর যোগ দেন বিমানের ট্রাফিক শাখায়। বর্তমানে তার পদবি জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার। অভিযোগ রয়েছে, বিমানের ট্রাফিক শাখায় যোগদানের পর নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন মিজানুর রহমান শিশির। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে জাল ভিসা বা বডি কন্ট্রাক্টে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে করছিলেন মানবপাচার। এছাড়া বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রীর লাগেজ কেটে মালামাল চুরি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশত্যাগে সহযোগিতা ও রাজনৈতিক পদ-পদবি ব্যবহার করে সহকর্মীদের বদলি-বাণিজ্য করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মিজানুর রহমান শিশিরের বিরুদ্ধে এমন তথ্য উঠে এসেছে। একই প্রতিবেদনে শিশিরের সঙ্গে মানবপাচারে বিমানের চেকিং স্টাফ কৃষ্ণ সুধা জড়িত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। জাল ভিসায় বিমানবন্দর পার হলেও ওই যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে আটকে যান। তারা তখন সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশনে না গিয়ে বিমানবন্দরে থাকা ‘অ্যাসাইলাম ডেক্সে’ গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। তখন তাদের ভিসা বৈধ না অবৈধ তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। উল্টো তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়।—বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাষ্য গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদনে নড়েচড়ে বসেছে খোদ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। পরে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তা তদন্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাফিকুর রহমানকে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। গত ২৫ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাহফুজা জেরিনের সই করা এক চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। আরও পড়ুনমালয়েশিয়ায় পাচারের শিকার গৃহকর্মী ১৬ বছর পর উদ্ধারঅবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তাভারতে জন্ম দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশি মা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, গত ৩০ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠি গ্রহণ করে বিমান। বিষয়টি এখন তদন্ত করছে বিমানের সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে শিশিরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। তারপর অধিকতর তদন্ত এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বডি কন্ট্রাক্টে ইউরোপ-আমেরিকায় মানবপাচার বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, মিজানুর রহমান শিশিরের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। পরে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য সূত্র ধরে বিমান মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর শিশির বিমানের কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগসাজশে ইমিগ্রেশনকে ম্যানেজ করে শাহজালাল বিমানবন্দর এবং সিলেট বিমানবন্দরের মাধ্যমে মানবপাচার কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। মন্ত্রণালয়ের চিঠি গ্রহণের পর ফাইল উত্থাপন করা হয়েছে। ফাইল অনুমোদনের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তারপর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণ হলে বিভাগীয় মামলাসহ আইনগত সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।—বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ অক্টোবর জাল ভিসাধারী একজন যাত্রীকে যুক্তরাজ্যে পাঠাতে চেষ্টা করেন শিশির। সে অনুযায়ী বডিং ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন যাত্রী। কিন্তু ওই যাত্রী আইএনএস গেটে গেলে বিমানের অন্য কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। তখন তাকে আইএনএস গেট থেকে অফলোড করা হয়। পরে গোয়েন্দা সংস্থা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ওই যাত্রীকে বিমানের বোর্ডিং পাস ও ইমিগ্রেশন পার করিয়ে দেওয়ার বডি কন্ট্রাক্ট হয়। অফলোড করা যাত্রীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সনদ ও ইংরেজি ভাষাগত জ্ঞান না থাকা এবং জাল স্টাডি ভিসা (পড়ার ভিসা) থাকা সত্ত্বেও তাকে বোর্ডিং পাস দেন বিমানের তৎকালীন চেকিং স্টাফ কৃষ্ণ সুধা। যার ৬ মাস আগেই ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে কৃষ্ণ সুধাকে পোস্টিং করান মিজানুর রহমান শিশির। এর আগে কৃষ্ণ সুধা সিলেট স্টেশনে মিজানুর রহমান শিশিরের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শাহজালাল বিমানবন্দরে শিশিরের অনৈতিক কর্মকাণ্ড গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য সূত্র ধরে বিমান মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল সময়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করেন মিজানুর রহমান শিশির। এসময় তিনি বিমান শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর এ রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে অফিসে নিয়মিত ডিউটি করেননি, যা তার ডিউটি রেজিস্টার যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা যেতে পারে বলে চিঠিতে জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ওই সময় মিজানুর রহমান শিশির বদলি-বাণিজ্য, মানবপাচার, ব্যাগেজ কাটিং, সোনা চোরাচালানসহ নানান অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে ২০১৯ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ এমন কর্মকাণ্ডের শাস্তিস্বরূপ তাকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বদলি করলে তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং তোফায়েল আহমেদের তদবিরে তিনি সিলেট স্টেশনে বদলি হন। সিলেট বিমানবন্দরে রাজনৈতিক প্রভাবে বেপরোয়া আচরণ শিশিরের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্যসূত্র ধরে বিমান মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পোস্টিংয়ের সময় ভিজিট ভিসার আড়ালে মানবপাচার, বডি কন্ট্রাক্ট, সাধারণ যাত্রী হয়রানি, সিলেটের স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়াসহ বিমানবন্দরে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তিনি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিদেশে পালানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন মর্মে গোপন সূত্রে জানা যায়। বিষয়টি স্থানীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা যেতে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্যসূত্র ধরে বিমান মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, মিজানুর রহমান শিশির তার স্ত্রীর মাধ্যমে সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডের মজুমদারিতে অবৈধভাবে আবরার টেলিকম নামে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা পরিচালনা করেন, যা বর্তমানে বন্ধ। ওই এজেন্সি সম্পর্কে প্রাথমিক তদন্তে লাইসেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি তদন্তপূর্বক যাচাই করা যেতে পারে। জুলাই হামলা-মামলার আসামি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, নিপীড়ন ও জুলুমে জড়িত থাকার অভিযোগে মিজানুর রহমান শিশিরের বিরুদ্ধে সিলেট মেট্রোপলিটনের এয়ারপোর্ট থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই বছরের ৬ নভেম্বর মামলাটি করা হয়। মামলায় ১৪৯/৩৩০/৩২৪/৩২৫/১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিশিরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে মতামত দিয়েছে বিমান মন্ত্রণালয়। আরও পড়ুনবিদেশে থাকায় অধরা মানবপাচারের মূলহোতারামানবপাচার মানুষের মর্যাদা ও অধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ রূপফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মানবপাচারকারীরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, বর্তমানে মিজানুর রহমান শিশির বিমানের যশোর স্টেশনে কর্মরত। বিমানের চেকিং স্টাফ কৃষ্ণ সুধা গ্রাউন্ডেড অবস্থায় আছেন। এ বিষয়ে জানতে গত ৪ ডিসেম্বর শিশিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এই প্রতিবেদকের নাম-পরিচয় দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি। এরপর গত ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ফোনকল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। বন্ধ পাওয়া যায় কৃষ্ণ সুধার ফোন নম্বরটিও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে বিমান ২১টি আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী পরিবহন করেছে। এর মধ্যে কানাডা, ইতালি, যুক্তরাজ্যে বডি কন্ট্রাক্টে লোক পাঠাতো ওই চক্রটি। আগে বিষয়টি অনেকে জানলেও তথ্য-প্রমাণ ছিল না। কিন্তু গত ২৬ অক্টোবর জাল ভিসাধারী হাতেনাতে ধরা পড়ার পর ওই যাত্রীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শিশির ও কৃষ্ণ সুধার এই মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এ চক্রের সঙ্গে আর কারা জড়িত, তা বের করতে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, জাল ভিসায় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে পার পেলেও ওই যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে আটকে যান। এক্ষেত্রে তারা তখন সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশনে না গিয়ে বিমানবন্দরে থাকা ‘অ্যাসাইলাম ডেক্সে’ গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। তখন তাদের ভিসা বৈধ না অবৈধ তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। উল্টো তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিমানসহ শাহজালাল বিমানবন্দরে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচার করে আসছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের চিঠি গ্রহণের পর ফাইল উত্থাপন করা হয়েছে। ফাইল অনুমোদনের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তারপর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণ হলে বিভাগীয় মামলাসহ আইনগত সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এমএমএ/এমকেআর/এমএফএ/এএসএম