ভুমিকম্প ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ: মুমিনের জন্যে সতর্কবার্তা

বিগত কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে গেল সবচেয়ে বড় ভুমিকম্প। বিশেষত ঢাকা শহর কেঁপে উঠেছিলো। মনে হচ্ছিল, সব এই ভেঙ্গে পড়বে।কুরআন ও হাদিস থেকে জানা যায়, সর্বপ্রথম সামুদ জাতিকে আল্লাহ তাদের পাপ ও দুস্কৃতির কারণে ভুমিকম্প দিয়ে শাস্তি দিয়েছিলেন। পরে লুত আলাইহিস সালাম এর জাতিকে। পরে বনী ঈসরাঈল এর এক দলকে পরে কারুনকে। (আখবারুয যালযালাহ পৃ. ০৮) ইমাম হাকিম রহ. বর্ণনা করেছেন, আম্মাজান আয়েশা রাযি. কে এক লোক ভুমিকম্প সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, লোকেরা যখন মুবাহ কাজের মতো ব্যপকভাবে যিনাহ করবে, শরাব পান করবে, গান-বাজনা করবে, তখন আল্লাহ সুবহানাহুর গাইরত উথলে ওঠে। অত:পর জমিনকে হুকুম দেন, এদেরকে কিছুটা নাড়া দাও। যদি তাওবাহ করে নেয়, তাহলে তো ঠিক আছে। নচেৎ দালানসমূহ পতিত করা হয়। (আল মুসতাদরাক ৪/৫১৬, হাদিস নং ৮৫৭৫) ইমাম ইবনে আবিদ্দুনয়া রহ. বর্ণনা করেন- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে একবার ভুমিকম্প হয়েছিলো। তখন নবীজি মাটিতে হাত মেরে বলেছিলেন,  থেমে যাও, সে সময় এখনো আসেনি। (যেহেতু কেয়ামতের সময় আসেনি, তাই শান্ত হয়ে যাও।) এরপর নবিজী সাহাবীগণকে বলেছিলেন, তোমাদের রব তোমাদের থেকে তাওবাহ চাচ্ছেন। (সুবুলুল হুদা ওয়াররাশাদ ৭/৩৫৩) হযরত থানভী রহ. বলেন, এ হাদীস থেকে বুঝা গেল ভুমিকম্পের কারণ “পাপ” এবং এর দ্বারা উদ্দেশ্য বান্দাদেরকে সতর্ক করা ও তাওবার প্রতি ধাবিত করা। (আখবারুয যালযালাহ পৃ. ৪) ইমাম ইবনে শাইবাহ রহ. বর্ণনা করেন, হযরত উমর রাযি. এর যুগে ভুমিকম্প হলে তিনি লোকজনকে বললেন, ভুমিকম্প হয়েছে। নিশ্চয়ই তোমরা কোনো নতুন পাপ করেছো। আমি কসম করে বলছি, আবার যদি কোনো দিন ভুমিকম্প হয়, তাহলে আমি আর তোমাদের সাথে থাকবো না। (সুবুলুল হুদা ৭/৩৫৪) ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. উল্লেখ করেন, উমর ইবনে আব্দুল আযিয রহ. বলেছেন, ভুমিকম্প দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে প্রতি তার রাগ প্রকাশ করেন। (আল জাওয়াবুল কাফি পৃ. ২৫৪) হজরত কাবে আহরাব রহ. বলেন, ভূমিকম্প তখন হয় যখন যমিনে মানুষ বেশি পরিমাণে গোনাহ করতে থাকে। (আল জাওয়াবুল কাফি পৃ. ২৫৪) হাদিসে এসেছে, পনেরোটি কারণে ভূমিকম্প আসবে। সবগুলোই আমাদের মাঝে বিরাজমান। তাই পাপ থেকে ফিরে আসা সময়ের দাবী। হাদীসটি হলো: হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ১. যখন গনীমতের যুদ্ধলব্দ (মাল) ব্যক্তিগন সম্পদে পরিণত হবে।২. আমানতের মাল লুটের মালে পরিণত হবে। ৩. যাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে। ৪. ধর্ম বিবর্জিত শিক্ষার প্রচলন হবে। ৫. পুরুষ স্ত্রীর আনুগত হয়ে যাবে। ৬. কিন্তু নিজ মায়ের অবাধ্য হবে। ৭. বন্ধু-বান্ধবকে কাছে টেনে নিবে ।৮. কিন্তু পিতা-মাতাকে দূরে ঠেলে দিবে। ৯. মসজিদে কলরব ও হট্রগোল করবে। ১০. পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হবে। ১১. নিকৃষ্ট লোক সমাজের কর্ণধার হবে। ১২. কোন মানুষের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্যে তাকে সম্মান দেখানো হবে। ১৩. গায়িকা-নর্তকী ও বাদ্য-যন্ত্রের বিস্তার ঘটবে। ১৪. মদ পান করা হবে। ১৫. এই উম্মতের শেষ যামানার লোকেরা তাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের অভিসম্পাত করবে। তখন তোমরা অগ্নিবায়ু, ভুমিকম্প, ভুমিধস, চেহারা বিকৃতি ও পাথর বর্ষণরুপ শাস্তির এবং আরো আলামতের অপেক্ষা করবে যা একের পর এক নিপতিত হতে থাকবে, যেমন পুরনো পুঁতিরমালা ছিড়ে গেলে একের পর এক তার পুঁতি ঝড়ে পড়তে থাকে। (তিরমিযী, হাদীস নং ২২১১)  মুসলিম উম্মাহর করণীয়১. তাওবাহ করা। ইরশাদ হয়েছে, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ أَمَنُوْا تُوْبُوا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوْحًا অর্থ: হে মুমিনগণ: আল্লাহর কাছে খাঁটি তাওবা করো। ২. আদম আলাইহিস সালাম এর দুআ পড়া। দুআটি নিম্নরুপ: رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْلَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ৩. হযরত নুহ আলাহিস সালাম এর দুআ পড়া। দুআটি হলো, وَأَنْ لَا تَغْفِرْلِيْ وَتَرْحَمْنِيْ أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ৪. হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম এর দুআ পড়া। দুআটি হলো,لَا إَلَاهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ أِنِّيْ كُنْتُ مِنَ  الظَّالِمِيْنَ ৫. দুআ পড়ার সাথে সাথে নফল নামাজ বেশি বেশি পড়া। হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যে কোনো বিষয় সামনে আসলে, তিনি নামাজ পড়তেন।  সাথে সাথে বেশি পরিমাণে নফল দান, সাদাকা পড়া। কেননা নফল দান দ্বারা বিপদ-আপদ দূর হয়। যদি মনে চায়, মাঠে-ময়দানে গিয়ে কান্নাকাটি করা, দুআ করা। আমাদের সমাজে ভুমিকম্পের সময় আযান দেওয়ার প্রচলন আছে। শরীয়ত দ্বারা এটা প্রমাণিত নয়। তাই এই বেদআতকে তরক করা উচিত। (আখবারুয যালযালা, পৃ. ১১, হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ.) প্রাকৃতিক দৃর্যোগজীবনে চলার পথে আমরা যেসব বিপদ ও সংকটের মুখোমুখি হই সেগুলো একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবার কেন্দ্রিক যেমন হতে পারে, তাতে আক্রান্ত হতে পারে একটি পুরো সমাজ, একটি দেশ কিংবা একটি বিস্তৃত এলাকা। এ সংকট আবার মানুষ সৃষ্ট কোনো কারণে হতে পারে (মানুষের ইচ্ছাকৃত এমন অপরাধ এর পিছনে দায়ী হতে পারে) আবাং বাহ্যত এমন অপরাধ নাও হতে পারে। এমন কোনো অপরাধ হতে পারে যেটাকে আমরা প্রাকৃতিক দূর্যোগ বলে থাকি। বিপদ যেমনই হোক, ছোট বা বড়, মানবসৃষ্ট কোনো কারণ এর পিছনে দায়ী থাকুক বা না থাকুক, সবরকমের বিপদে আমাদের একি কথা- সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। আত্মবিশ্বাসী মু’মিন যারা, তাদের বিশ্বাস এটিই।  আরও পড়ুন: ওমরাহ পালন করে আবেগঘন বার্তা দিলেন টিকটক কিং খাবি লেইমوَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرِّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَا هُوَ، وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرِ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ،يُصِيْبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ،  وَهُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ ‘আল্লাহ তোমাদের কোনো বিপদ দিলে তিনি ব্যতিত তা দূর করার কেউ নেই। আর তিনি যদি তোমার কোনো কল্যান চান তবে তার অনুগ্রহ রদ করারও কেউ নেই। স্বীয় বান্দাদের মধ্যে তিনি যাকে ইচ্ছা, মঙ্গল দান করেন। তিনিই মহাক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা, ইউনুস, আয়াত ১০) আমাদের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে, তা নিজ শক্তিতে হয় না। সবকিছুর পেছনে রয়েছে মহাশক্তিধর রব্বুল আলামিনের হুকুম। এটা আমাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অংশ। নবী আলাইহিস সালাম আমাদের ঈমানের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে, أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِه وَكُتِبِهِ وُرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ তুমি আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের উপরও’। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ০৮)আরেকটি হাদীসে বিস্তারীত বলা হয়েছে, لَا يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ، حَتَّى يَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَهُ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَهُ، وَأَنَّ مَا أَخْطَئَهُ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيْبَهُ. কোনো বান্দা ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ সে তাকদীরের ভালো-মন্দের উপর ঈমান না আনে। তাকে এ বিশ্বাস করতে হবে- ভালো-মন্দ যা কিছু তার ভাগ্যে জুুটেছে, তা ছুটে যাওয়ার মতো ছিলো না। আর যা ছুটে গেছে তা পাওয়ারও ছিলো না। (সুনানে তিরমিযী ২১৪৪) আসলে এই পৃথিবীর কোনো কিছুই আপন শক্তিতে ঘটে না। ছোট-বড় সবকিছুই রব্বুল আলামিনের হুকুমের প্রতিফলন। তার আদেশেই সব কিছু হয়। অনেক কিছুকে আমরা আকস্মিক মনে করি। কিন্তু যাতে বারি তাআলা এর নিকটে কোনো কিছুই অপরিকল্পিত নয়।  ইরশাদ হয়েছে,  وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ، وَيَعْلَمُ مَا فِيْ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إَلَا يَعْلَمُهَاوَلَا حَبَّةٍ فِيْ ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إَلَّا فِيْ كِتَابٍ مُّبِيْنٌ ‘অদৃশ্যের চাবিসমূহ তার কাছে রয়েছে। তিনি ছাড়া তা আর কেউ জানে না। জলে-স্থলে যা রয়েছে তা তিনি জানেন। আর এমন কোনো পাতা ঝড়ে পড়ে না এবং মাটির অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণা কিংবা আর্দ্র বা শুস্ক এমন কিছু নেই, যা তিনি জানেন না, যা এক সুস্পষ্ট কিতাবে নেই’। (সুরা আনআম, আয়াত ৫৯) দুনিয়াতে আল্লাহ মানুষকে বিপদ দেন। এটা এই দুনিয়ার এক স্বাভাবিকতা। বিপদ নানা-রকমের হতে পারে। জান-মাল, সহায়সম্পদ, সন্তনাদি, পরিবারপরিজন, সম্মান ইত্যাদি নানা বিষয়ে মানুষ বিপদাক্রান্ত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ﴿وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَیۡءࣲ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصࣲ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَ ا⁠لِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَ ا⁠تِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّـٰبِرِینَ﴾ [البقرة ١٥٥] আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরিক্ষা করবো সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও-যারা কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তার দিকে ফিরে যাবো। ইরশাদ হয়েছে, ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِی ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَیۡدِی ٱلنَّاسِ لِیُذِیقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِی عَمِلُوا۟ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ ‘মানুষের কৃত-কর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, যেন তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যেন তারা ফিরে আসে। (সুরা রুম, আয়াত ৪১)এমন অনেক আয়াত আছে যার থেকে আমরা নির্দেশনা পাই: ১. দুনিয়াতে নানারকম বিপদ দিয়ে আল্লাহ তা’আলা পরিক্ষা করতে পারেন। ২. সে পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে সবর ও ধৈর্যের পরিক্ষা দিতে হবে। ৩. বিপদে মুমিনের সান্তনা- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ৪. জগতের যত বিপর্যয় তা মানুষেরই কৃতকর্মের ফল। ৫. আল্লাহ মানুষকে দুনিয়াতে শাস্তি দেন সতর্ক করার জন্যে। ৬. দুনিয়াতে আল্লাহ তা’আলা যেই শাস্তি দেন, তা আখিরাতের তুলনায় খুবই সামান্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সতর্ক হওয়ার  তাওফীক দান করেন। আমিন। লেখক: মুহাদ্দিস, মারকাযুল কুরআন মাদরাসা আদিতমারী, লালমনিরহাট