মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে ৯ মেগা প্রকল্পের উদ্যোগ

মোংলা সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সমুদ্রবন্দরকে আধুনিক ও বিশ্বমানের নৌ-যোগাযোগ কেন্দ্রে রূপান্তর করতে নেয়া হয়েছে ৯টি বড় ‘মেগা প্রকল্প’। এর মধ্যে ৪টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে এবং নতুন করে ২টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরও ৩টি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে মোংলা বন্দরের বহুমুখী টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে এবং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। ব্যবসায়ীদের জন্য এটি লাভজনক ও ব্যবসাবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির আঞ্চলিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে উঠবে মোংলা বন্দর। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত এই বন্দরের আধুনিকায়ন ও কার্যক্রম সম্প্রসারণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬০৬ কোটি ৪১ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ এবং ‘বন্দরের চ্যানেল সংরক্ষণ ড্রেজিং’ নামের ২টি মেগা প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্প দুটি শেষ হলে পণ্য খালাস-বোঝাই সহজ হবে এবং সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দর চ্যানেলে অনায়েসে আসা-যাওয়া করতে পারবে। ফলে ১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি-রফতানি ও ৪ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। এছাড়া পূর্বে গৃহীত ৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা বন্দরের সহায়ক জলযান সংগ্রহ, পশুর চ্যানেলে ইনারবার ড্রেজিং, আপগ্রেডেশন অব মোংলা পোর্ট ও ২টি অসম্পূর্ণ জেটি নির্মাণ নামের ৪টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বন্দরকে আরও গতিশীল করতে নতুন করে ৩টি বড় প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো হলো: ‘পশুর চ্যানেল শাসন ও সম্প্রসারণের জন্য সমীক্ষা’, ‘ট্রেলিং সাকশন হপার ও কাটার সাকশন ৩টি ড্রেজার ক্রয়’ এবং ‘উন্নয়ন সেবা সহায়ক ২টি মুরিং বোট সংগ্রহ’ প্রকল্প।  আরও পড়ুন: বিজয় দিবসে মোংলায় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের ৩ যুদ্ধজাহাজ উন্মুক্ত এসব প্রকল্প শেষ হলে চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষা, পণ্যবোঝাই জাহাজ দ্রুত ভেড়ানো ও ত্যাগ করা এবং বন্দরের কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, স্টিভিডরস ও শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি অন্য বন্দরগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক ও বিশ্বমানের নৌ-যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত হবে মোংলা বন্দর। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (অর্থ) ও পরিচালক (প্রশাসন) উপসচিব কাজী আবেদ হোসেন বলেন, ‘নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও তেল নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জাহাজ ও আশপাশের শিল্পকারখানাগুলোর বর্জ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করা হবে। এটি সমুদ্রদূষণ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মারপোল কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা সুন্দরবন ও পশুর চ্যানেলকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাকি চারটি প্রকল্পের নির্মাণকাজও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে জরুরি সেবা ও কার্যকর পরিচালনার জন্য সহায়ক জলযান সংগ্রহ এবং পশুর চ্যানেলের ইনার বার এলাকায় ৮.৫ মিটার গভীরতা অর্জনের লক্ষ্যে ড্রেজিং করা, যাতে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজগুলো ওই চ্যানেল দিয়ে নিরাপদে চলাচল করতে পারে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর জেটিতে অতিরিক্ত ১০০ থেকে ১৫০টি জাহাজের পণ্য হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। ফলে জাহাজের পণ্য খালাস-বোঝাই সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে।’ আরও পড়ুন: ৭৫ বছরে পা রাখলো মোংলা বন্দর, বর্ণাঢ্য আয়োজনে তুলে ধরা হলো সক্ষমতা বন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে মোংলা বন্দরে জাহাজজট নেই। ফলে বন্দর ব্যবহারকারীরা ভালো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। গাড়ি আমদানিকারকদের জন্য বিশেষ সুবিধাসহ সাতটি কনটেইনার ইয়ার্ড রয়েছে। এছাড়া ৩৮টি সহায়ক জলযান (যেমন- টাগবোট, পাইলট বোট, সার্ভে বোট, ড্রেজার) রয়েছে। আন্তর্জাতিক ‘শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি (আইএসপিএস)’ কোড অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল এবং সহজলভ্য সড়ক, রেল ও নৌ-পথে পণ্য পরিবহনের ব্যাপক সুযোগও রয়েছে এই বন্দরে। বর্তমানে মোংলা বন্দরের বার্ষিক সক্ষমতা হলো ১ হাজার ৫০০টি জাহাজ হ্যান্ডলিং, ১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন কার্গো, ১ লাখ টিইইউ কনটেইনার এবং ২০ হাজার গাড়ি হ্যান্ডলিং। এছাড়া জেটিতে ৮.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর সক্ষমতা, ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেলে পানির ওপরে ভাসমান নৌযান সংকেত যন্ত্র ও টাওয়ার দিয়ে রাত-দিন নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা, বিদেশি জাহাজের জন্য ৪৯টি নির্ধারিত বার্থিং পয়েন্ট, ১৩৪টি আধুনিক কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং যন্ত্র এবং নিরাপদ সংরক্ষণ ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু রয়েছে। যার আওতায় অনুমতি, বিল, ইনডেন্টিং, যন্ত্রপাতি বুকিং ও পেমেন্ট একই জায়গায় করতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহীন রহমান বলেন, ‘ভৌগোলিক দিক থেকে মোংলা বন্দরের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্দর দিয়ে নেপাল, ভুটান, চীন ও ভারতের পণ্য আমদানি-রফতানি হয়। বর্তমানে প্রতিবেশী দেশগুলোর আগ্রহের কারণে বন্দরের ওপর চাপ বাড়ছে। এজন্য এর সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হবে। প্রকল্পগুলো শেষ হলে মোংলা বন্দর হবে বিশ্বের বাণিজ্যিক বাজারে পরিবেশবান্ধব ও অন্য বন্দরের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সমুদ্রবন্দর।’ এদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১৪ কোটি ৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও তেল নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যা এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।