সেন্টমার্টিনের টিকিট জালিয়াতি ঠেকাতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এনআইডি যাচাই

সরকারি সিদ্ধান্ত ও নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে সেন্টমার্টিনের জাহাজ টিকিট জালিয়াতি রোধে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর ঘাটে অবস্থান করে কঠোর নজরদারি শুরু করা হয়েছে।প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন। তবে নানা বিধিনিষেধের মধ্যেই জাহাজের টিকিট নিয়ে তৈরি হয়েছে বিড়ম্বনা। পাশাপাশি জালিয়াতি চক্র সক্রিয় থাকার অভিযোগ উঠেছে। এসব জালিয়াতি ঠেকাতে টিকিটে উল্লিখিত নামধারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) হার্ডকপি অথবা নিবন্ধিত মোবাইল নম্বর যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাচাই ছাড়া কোনো যাত্রীকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার রিজিয়নের প্রধান ও অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা জাহাজ চলাচল শুরুর পর থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি। ইতোমধ্যে জালিয়াতির বেশ কিছু ঘটনা সামনে আসায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কালোবাজারির মাধ্যমে পর্যটক হয়রানি কঠোরভাবে দমন করা হবে।’ কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানজিলা তাসনিম জানিয়েছেন, তাদের টিম প্রতিদিন দুই প্রান্তের ঘাটে (কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন) নিয়োজিত রয়েছে। আগত পর্যটকদের পরিবেশ সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে চলতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি অভিযোগ ও অনিয়ম তদারকি করা হচ্ছে। কোনো অনিয়মের প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জাহাজ মালিকরা জানিয়েছেন, গত ১ ডিসেম্বর থেকে সরকার নির্ধারিত কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে প্রতিদিন চলাচল করছে অনুমতিপ্রাপ্ত ৬টি জাহাজ। যাত্রার প্রথম ১৭ দিনে (১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত) প্রায় ৩০ হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেছেন। ট্রাভেল পাস সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইটের (travelpass.gov.bd) তথ্যানুযায়ী, গত ১৬ ডিসেম্বর নির্ধারিত ২ হাজার পাসের সবকটিই ইস্যু হয়েছে, যা একক দিন হিসেবে সর্বোচ্চ। ইতোমধ্যে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আগামী ৩০ দিনের নির্ধারিত প্রায় ৬০ হাজার টিকিটের মধ্যে অধিকাংশ টিকিটই অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ। আরও পড়ুন: মাঝ সাগরে ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল, ৪৫ যাত্রী উদ্ধার সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘বছর কয়েক আগেও ৫ মাস যাবৎ দৈনিক ৫-১০ হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেতেন। এখন মাত্র ২ মাস প্রতিদিন ২ হাজার পর্যটক যেতে পারছেন। এমন পরিস্থিতিতে টিকিটের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় সব টিকিট শেষ। দৈনিক হারে ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকের সংখ্যা গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি।’ এদিকে অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে একটি জালিয়াতি চক্র সিন্ডিকেট করে অসাধু অনলাইন এজেন্টদের মাধ্যমে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করছে। পরবর্তীতে চড়া দামে অবৈধভাবে কালোবাজারির মাধ্যমে তা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছে। এ ব্যাপারে হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘এবার টিকিট বিক্রি এবং পর্যটক যাতায়াতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি রয়েছে। প্রতিদিনই প্রশাসন ঘাটে আসছে। টিকিট বিক্রির সময় এনআইডি নম্বর ব্যবহার ও ভ্রমণ পাস জরুরি। ফলে কালোবাজারে টিকিট বিক্রির সুযোগ নেই। তবে এক শ্রেণির চক্র তাদের বা বিভিন্ন জনের এনআইডি ব্যবহার করে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করে তা অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। অবশ্য তার সংখ্যা খুবই কম।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর সঙ্গে জাহাজের টিকিট সংগ্রহ ও ভ্রমণ পাস নিয়েও অনেকের ভ্রমণ বাতিল হচ্ছে। এসব টিকিট সরাসরি ফেরত দিলে কিছু টাকা কম ফেরত পাবেন। তাই ওই সব টিকিটও দালালরা ক্রয় করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে। এ ব্যাপারে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।’ সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ব্যাপারে গত ২২ অক্টোবর ১২টি নির্দেশনাসহ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারি সিদ্ধান্ত মতে, বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ ছিল। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে পর্যটকদের মানতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা। আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিনের জাহাজের আগাম ১ মাসের টিকিট বিক্রি শেষ, কালোবাজারির অভিযোগ সরকারি প্রজ্ঞাপন মতে, নভেম্বরে পর্যটকরা শুধু দিনের বেলায় দ্বীপটি ভ্রমণ করতে পারতেন, রাত যাপন করতে পারতেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস রাত যাপনের সুযোগ থাকবে। এছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচলের অনুমতি পাবে না। পর্যটকদের অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড সংযুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে। তথ্য অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে পারবেন পর্যটকরা। আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার ৯ মাসের জন্য দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। পর্যটকদের ভ্রমণকালে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষেধ। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। ভ্রমণকালে নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।