নিরাপদ পানির অভাবে বাগেরহাটের আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারে বাচ্চা উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ত পানির কারণে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো ইনকিউবেটরসহ নানা যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। প্রায় আড়াই বছর ধরে পানির কুলিং ফ্যান ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি অচল পড়ে আছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্রুত খামারে সুপেয় পানির ব্যবস্থা না হলে ডিম থেকে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।২০১২ সালে আমিষের ঘাটতি পূরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখার লক্ষ্য নিয়ে আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বাগেরহাটের আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার। শুরু থেকেই এই খামার থেকে নিয়মিত ডিম ও প্রায় অর্ধ লাখ হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে, যা দক্ষিণাঞ্চলের হাঁস খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে খামারটির বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানির সংকট। খামারে স্থাপিত নলকূপের পানিতে আয়রন ও লবণাক্ততার মাত্রা বেশি হওয়ায় শেডগুলোতে মরিচা ধরছে। বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটর মেশিন, দেয়ালের পলেস্তারা ও সুরক্ষা নেট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাঁস পালনের জন্য নির্মিত ছয়টি লেয়ার শেডসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও লোনা পানির কারণে বিকল হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে দিন দিন কমছে হাঁসের উৎপাদন, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি টাকার সরকারি যন্ত্রপাতি। আরও পড়ুন: জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাঁসের নতুন জাত 'বাউ-ডাক', ৩ গুণ ডিম-মাংস! বর্তমানে খামারে চায়না বেইজিং ও জিংডিং জাতের হাঁস উৎপাদন করা হচ্ছে। খামার আধুনিকায়ন ও সুপেয় পানির স্থায়ী ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের কাঁঠালতলা এলাকায় প্রায় তিন একর জমিতে দুই দশক আগে নির্মাণ করা হয় সরকারি মোরগ-মুরগি পালন কেন্দ্র। পরবর্তীতে দক্ষিণাঞ্চলে হাঁস খামারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ওই কেন্দ্রটিকেই রূপান্তর করা হয় আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারে। হাঁস পালন ও প্রজনন, বাচ্চা ও ডিম বিক্রয় এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যেই এই খামার গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে খামারে ছয়টি লেয়ার শেডের পাশাপাশি অফিস ভবন, ডরমেটরি, হ্যাচারি, ব্রুডার শেড, গ্রোয়ার শেড, গোডাউন, গ্যারেজ, পাম্প হাউজ ও জেনারেটর হাউজ রয়েছে। কাড়াপাড়া এলাকার খামারি হাসনা বেগম জানান, ‘খামার থেকে ২৫ টাকা করে হাঁসের বাচ্চা কিনে আনি। বাচ্চার মান ভালো হওয়ায় কয়েক মাস লালন-পালনের পর ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করি। বাইরে থেকে কিনতে গেলে এ খরচ আরও বেশি পড়ত।’ একই এলাকার আরেক খামারি জোহরা খাতুন বলেন, ‘অল্প পরিসরে হাঁস পালন করি। হাঁস বড় হলে নিজের পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করেও কিছু আয় হয়, যা হাতখরচে সহায়তা করে।’ খামারের আউটসোর্সিং কর্মী মো. জয়নুল আবেদীন জানান, ‘একটি লেয়ার শেডে প্রায় ৫০০ হাঁস রয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০টি ডিম উৎপাদন হয়। তবে খামারের মূল সমস্যা হলো লবণাক্ত ও আয়রনযুক্ত পানি। এর ফলে ইনকিউবেটর মেশিনগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর চিলার মেশিনগুলো একেবারেই অচল হয়ে পড়ে আছে। মিঠা পানির ব্যবস্থা করা গেলে এসব সরকারি যন্ত্রপাতি রক্ষা করা সম্ভব।‘ আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারের পোলট্রি টেকনিশিয়ান উজ্জ্বল কুমার রায় জানান, ‘চলতি সময়ে বাচ্চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার। এর বিপরীতে নভেম্বরের মধ্যেই প্রায় ৩৫ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করা হয়েছে। প্রান্তিক খামারিদের অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি মূল্যে ২৫ টাকায় বাচ্চা সরবরাহ করা হয়। এতে পারিবারিকভাবে হাঁস খামার গড়ে উঠছে, তৈরি হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থান এবং বাড়ছে পরিবারের সচ্ছলতা। তবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে মিঠা পানির ব্যবস্থা না করলে ভবিষ্যতে বাচ্চা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এ. এফ. এম ফয়জুল ইসলাম বলেন, এখানকার উৎপাদিত হাঁসের বাচ্চা মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, চিতলমারীসহ বাগেরহাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে এবং উৎপাদনে দেশজুড়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে খামারটি। লবণাক্ত ও আয়রনযুক্ত পানির কারণে ইনকিউবেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রক্ষায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে মিঠা পানির বিকল্প ব্যবস্থা জরুরি। তিনি আরও জানান, খামারে বর্তমানে কোনো নিরাপত্তা প্রহরী নেই। এতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। খামারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত নিরাপত্তা প্রহরীর পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আরও পড়ুন: হাওরে হাঁসের খামারে দিন বদলের স্বপ্ন কিশোরগঞ্জের খামারিদের খামারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৬০ হাজার ও ১ লাখ ৮০ হাজার; উৎপাদিত হয়েছিল যথাক্রমে ৭৭ হাজার ৬৮৮টি ও ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৪টি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৬০ হাজার ও ১ লাখ ৮০ হাজার। উৎপাদিত হয় যথাক্রমে ৫৪ হাজার ৪০১টি ও ১ লাখ ৩০ হাজার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫০ হাজার ও ১ লাখ ৮০ হাজার। উৎপাদিত হয়েছিল যথাক্রমে ৫৩ হাজার ৮৭৪টি ও ১ হাজার ৫৭ হাজার ৮৭ টি। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মতো হলেও উৎপাদিত হয়েছে যথাক্রমে ৭৫ হাজার ১৩০টি ও ১ লাখ ৭০ হাজার ৯৩৯ টি। সবশেষ চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৫০ হাজার ও ১ লাখ ৮০ হাজার। এখন পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৮৪০টি ও ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩৩টি।