২০ ডিসেম্বর দিনটি মৌলভীবাজারবাসীর জন্য অত্যন্ত বেদনাময়। বিজয় দিবসের ঠিক চারদিন পর রহস্যজনক এক মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন বিভিন্ন স্থান থেকে এসে আশ্রয় নেয়া ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রতি বছর এই দিনটিকে স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে জেলার মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও ওই মাইন বিস্ফোরণের রহস্য জানা যায়নি।দিবসটি উপলক্ষে শনিবার (২০ ডিসেম্বর) সকাল ৯টায় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্মিত শহীদ ফলকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জেলা প্রশাসক তৌহিদুজ্জামান পাভেল ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল। পরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় মৌলভীবাজার জেলা। এরপর ১৬ ডিসেম্বর পুরো দেশ শত্রুমুক্ত হলে বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সারাদেশ। মুক্ত দেশে মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিভিন্ন সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে এসে জড়ো হন। সেখানে জমা পড়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা ট্যাংক বিধ্বংসী মাইনও তুলে এনে রাখা হয় ওই বিদ্যালয়ে। ২০ ডিসেম্বর দুপুরবেলা। বীর মুক্তিযোদ্ধারা সবেমাত্র খেতে বসেছেন। বাড়ি ফেরা ও সংসারের হাল ধরার পরিকল্পনা নিয়ে মশগুল সবাই। ঠিক সেই সময়েই আকস্মিক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। শক্তিশালী বিস্ফোরণের আঘাতে বিদ্যালয়ের দেয়াল, টিনের চাল ও মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিদ্যালয় মাঠের পাশে সমাধিস্থ করা হয় বিস্ফোরণে শহীদ ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। হতভাগ্য এসব মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে দিনটিকে স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং স্থাপন করা হয় শহীদদের নামফলক। আরও পড়ুন: পরিবেশদূষণ ঠেকাতে মৌলভীবাজারে পলিথিন বিক্রির হাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আহ্বায়ক মো. জামাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সেদিন ক্যাম্পে বিস্ফোরকগুলো একত্রিত করে রাখাটাই বড় ভুল ছিল। আর এ ভুলের কারণেই এ রকম এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।’ তিনি আক্ষেপ করে জানান, অনেক সরকার আসলেও এই ঘটনার সঠিক কোনো তদন্ত হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ আইনজীবী মুজিবুর রহমান মুজিব ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, তিনি এদিন তার শাহ্ মোস্তফা রোডের বাসায় ছিলেন। দুপুরের দিকে আকস্মিক বিস্ফোরণে তার ঘরের দরজা-জানালাগুলো অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে তিনি মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়কে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখেন। সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. জামাল উদ্দিনসহ অনেকেই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সেই নির্মম পরিণতির কথা তুলে ধরেন। তাদের দাবি, দিনটিকে স্থানীয়ভাবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক এবং স্মৃতিফলকটি সম্প্রসারণ করা হোক। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক তৌহিদুজ্জামান পাভেল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকটি সম্প্রসারণের আশ্বাস দেন।