হাসান জাহিদ জলবায়ুু পরিবর্তন মানব জাতির সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি যে কোনো মানদণ্ডেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও পরিবেশদূষণ এরই মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি আঘাত হানছে। বায়ুদূষণ, নানা রোগ, চরম আবহাওয়ার ঘটনা, জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ প্রভৃতি বেড়েই চলেছে। সেইসঙ্গে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ক্ষতি করছে ফসল, জমি, গাছ, পানি, জীব-জন্তু ও ইকোসিস্টেমের। একুশ শতকের প্রথম কয়েক দশকেই জলবায়ু পরিবর্তনের বহুবিধ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এরমধ্যে ২০২৪ সাল ছিল এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ বছর। যেখানে গড় উষ্ণতা ১৮৫০ সাল থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ শুরুর পর থেকে ১.৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২.৮৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেড়েছে। অতিরিক্ত উষ্ণতা প্রভাবগুলো আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং টিপিংপয়েন্ট সক্রিয় করতে পারে, যেমন পুরো গ্রিনল্যান্ডের বরফ আস্তর গলে যাওয়ার সম্ভাবনা। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অনেকগুলো কপ (জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ) অনুষ্ঠিত হতে দেখেছি। যে সম্মেলনগুলোর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে কার্বন ও অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো। কিন্তু আমরা দেখছি অন্য চিত্র। প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায় বিতর্ক, কে কমাবে, কে কমাবে না—এ নিয়ে মতবিরোধ। যার শিকার হচ্ছে ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে নাজুক দেশ বাংলাদেশ ও দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও বৈশ্বিক কুপ্রভাব এই দেশকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বরফ, আইস ক্যাপ ও হিমবাহ গলে সমুদপৃষ্ঠ স্ফিত হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, তথা উপকূলীয় অঞ্চল চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সিংহভাগ এলাকা সমুদ্রের পানির তলে ডুবে যাওয়ার হুমকির মুখে রয়েছে। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ না করেও বৈশ্বিক উষ্ণতার শিকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, এই দেশ অতিরিক্ত ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নিষিক্ত না করেও ভূমণ্ডলীয় প্রভাবের শিকার হয়ে ধুঁকছে এর প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, ইকোসিস্টেম, বনাঞ্চল, নদ-নদী, বায়ু, পানি ও মাটি। উপকূলীয় অঞ্চল বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের শিকার। এর সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের নজিরবিহীন প্রতিযোগিতা। বন উজাড়, জলাভূমি সংকোচন, নদীদূষণ ও প্রাণীর আবাসস্থল বিনাশ, পাহাড় কর্তন এবং নানাবিধ দূষণ ছড়িয়ে প্রকৃতিকে সংকুচিত করে তুলেছে। এর ফলে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। শতবছর ধরে যা ধ্বংস হয়েছে, তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা নয়, এখন একমাত্র প্রতিকার হলো প্রকৃতি ধ্বংস প্রতিরোধ করা এবং বর্তমান বিরূপ পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় এখন ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে। নদীভাঙনের শিকার হয়ে, বসত হারিয়ে অসংখ্য মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকবে অ্যাডেপ্টেশন বা পরিবর্তিত বিরূপ পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। ধনী ও শক্তিধর দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাবে না, এটা এখন পরিষ্কার। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ ৩০ (১০-২১ নভেম্বর) চলেছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রাজিলের আমাজন রেইনফরেস্ট ঘেঁষা শহর বেলেমে। উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে বনাঞ্চল নিধন বন্ধ করা। ফলাফল আমাদের জানা আছে। শক্তিধর দেশগুলোর একই কথা। মানে সব শেয়ালের এক রা। তারা আমাদের উপদেশ দেবে, তোমরা সিংক বাড়াও, আমরা অর্থ দেবো। মোটা দাগে বললে বলতে হয়, বিশ্ব ফোরামে আমাদের শক্তিশালী নেগোসিয়েশনে যেতে হবে। ফান্ড আদায় করতে হবে। সেই ফান্ড যেন দেশের সুরক্ষায় যথাযথভাবে কাজে লাগে। সিংক তৈরির অন্যতম উপাদান বৃক্ষরোপণ। বন সংরক্ষণ, ইকোসিস্টেম রক্ষা করা আর নতুন বনায়ন কার্যক্রম বেগবান করা। দেখা গেছে, নির্বিবাদে বৃক্ষ কর্তনের ফলে মাটি উদোম হয়ে ক্ষয়ে যায়। মাটি দৃঢ়তা হারায়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীদের আবাসস্থল বিলুপ্ত হয়। >> কপ ৩০-এর সিদ্ধান্তের মধ্যে ভালো দিকগুলো হলো: ‘বেলেম রাজনৈতিক প্যাকেজ’ নামে ২৯টি সিদ্ধান্তযুক্ত একটি প্যাকেজ পাস করা সম্ভব হয়েছে। প্যাকেজে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে— ১. উষ্ণমণ্ডলীয় বন ও আদিবাসী অধিকারভিত্তিক বৈশ্বিক জলবায়ু সংহতি; ২. প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিতকরণ; ৩. অভিযোজন অর্থায়ন বৃদ্ধির অঙ্গীকার; ৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামো শক্তিশালীকরণ; ৫. জলবায়ুনীতিতে লিঙ্গসমতা পদক্ষেপ এবং ৬. জলবায়ুবান্ধব ন্যায্য বাণিজ্য ও সবুজ অর্থনীতির দিকে রূপান্তরের নীতি উল্লেখযোগ্য। তবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে এবারও সিদ্ধান্ত হয়নি। সেটা অদূর ভবিষ্যতে হবে কি না, আগাম বলা কঠিন। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, দেশগুলো সম্মিলিতভাবে উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে এ চুক্তির আওতায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৫.০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছাতে পারে। উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন প্রায় অর্ধেকে নামাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্য নির্গমন অর্জন করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, তাতে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফিত হয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ক্ষতির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি মানবসৃষ্ট, প্রাকৃতিক কারসাজি নয়—এটি বিশ্বে আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। এই অমোঘ সত্যটাকে বহুবছর যাবত ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত ছিল বিশ্বের শিল্পোন্নত কতিপয় দেশ। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উন্নত ও শিল্পায়িত বিশ্বের লাগামহীন কার্বন নিঃসরণের শিকার এখন গোটা বিশ্ব; কেননা উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলছে আর তা স্ফিত করে তুলছে সাগর-মহাসাগরকে। যার ফলে অধিক ভুগবে বিশ্বের দ্বীপরাষ্ট্রসহ নিম্নাঞ্চলীয় নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশ। >> করণীয়জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে তা থেকে অধিক মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। প্রতিনিয়ত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে তেল, গ্যাস বিশেষ করে কয়লা ব্যবহার করি। বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ আটকে রেখে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে অবশ্যই দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে প্রথম সারির দেশগুলো (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত) এ জ্বালানি ব্যবহার হ্রাসের বিপক্ষে। মিথেন গ্যাস নিগর্মন হ্রাস করা জাতিসংঘের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মিথেন গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করা গেলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব। মিথেন গ্যাস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে। তেল নিষ্কাশনের সময় প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো হয় যা থেকে ব্যাপক মাত্রায় মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। অবশ্যই প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর বিকল্প হিসেবে ভিন্ন পরিবেশবান্ধব উপায় বের করতে হবে। এর মাধ্যমে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস পাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে জ্বালানিখাত ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বৈশ্বিক অর্থনীতির যে কোনো খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ ও তাপশক্তি উৎপাদন খাত জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বিশ্বের নেতাদের একযোগে কাজ করতে হবে। সভ্যতার উন্নতির ধারায় প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ ও তাপের ব্যবহার বাড়বে কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে একদিকে বিদ্যুৎ বা তাপের চাহিদা পূরণ হবে, অন্যদিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক লক্ষ্য ও চাহিদা বিবেচনায় এমন পদক্ষেপ কঠিন হবে। অন্যদিকে বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের ফলে জ্বালানি চাহিদা মিটতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব নেতাদের প্রস্তাবিত নিট জিরো বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য তথা বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। তবে এই পথ খুব মসৃণ নয়। কারণ বাতাসের গতিবেগ কম হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত ব্যাটারি উদ্ভাবনের পথে হাঁটতে হবে যেন প্রয়োজনীয় শক্তি তথা বিদ্যুৎ সঞ্চয় এবং প্রয়োজনমাফিক তার ব্যবহার করা যায়। পেট্রোল ও ডিজেলের ব্যবহার সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। প্রতিনিয়ত সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে নতুন নতুন বাহনের ব্যবহার বাড়ছে। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল, অকটেনের মতো জ্বালানি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অবশ্যই যানবাহনে ডিজেল ও পেট্রোলের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। এসব জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে একটি সমাধান। তবে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি যথেষ্ট জটিল কাজ। এ ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন জ্বালানি হতে পারে যানবাহনের উৎকৃষ্ট জ্বালানি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত হাইড্রোজেন জ্বালানি আগামীতে পরিবেশবান্ধব পরিবহন খাতের স্বপ্ন দেখাতে পারে। বৃক্ষরোপণের হার বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে বৃক্ষরোপণের চেয়ে ফলদায়ক পদ্ধতি আর হতে পারে না। প্রয়োজনের তাগিদে গাছ কাটা হলেও বৃক্ষরোপণের হার বাড়াতে হবে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানায়, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস দূর করতে হবে। বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূর করতে গাছের বিকল্প নেই। তাছাড়া, জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষ ও জলাভূমির কোনো বিকল্প নেই। পরিতাপের বিষয়, গাছপালা-বৃক্ষ, বনভূমি সাফ করে আমাদের দেশে, এমনকি ফসলের জমিতেও ইটভাটা, তীব্র পানিদূষণকারী ডায়িং কারখানা ও কম্পোজিট মিল তৈরি হচ্ছে। এগুলো অবশ্যই আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করছে। বায়ু থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস দূরীকরণ গ্রিনহাউস গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ার পর মহাশূন্যে বিলীন হওয়ার পথে বাধা। ফলে পৃথিবী উষ্ণ থাকে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্রা অধিক হলে পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়। আরও পড়ুনভেজালমুক্ত খেজুর গুড়ের উদ্যোক্তা তরুণ নার্স সিজান মাদারীপুরে হর্টিকালচার সেন্টারে ২০০ প্রজাতির ক্যাকটাস সমস্যা হলো বিশ্বের শক্তিধর ও প্রভাবশালী দেশগুলো নিজেদের শিল্প ও উৎপাদনের হার বাড়াতে চায়। ফলে তারা নিজেদের দেশের কার্বন নিঃসরণ না কমিয়ে অন্য দেশগুলোকে সিংক বানাতে চাইছে এবং ফান্ড ও গ্রিন টেকনোলজি দিয়ে দূষণ কমাতে চাইছে। এটা সুদূরপ্রসারী কোনো ফল বয়ে আনবে না। প্রায় প্রতিটি কপ (জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ) সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত আসে ফান্ড প্রদানের এবং টেকনোলজি ট্রান্সফারের। বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রিনহাউজ গ্যাস কৃত্রিমভাবে দূর করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অথবা গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পর এর উৎস থেকে অন্য স্থানে সম্প্রসারণ রোধ করা গেলে পরিবেশে এসব গ্যাসের প্রভাব অনেকাংশে স্তিমিত করা যায়। এরই মধ্যে কয়েকটি উন্নত দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস দূর করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে টেক্সাসের ‘কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং সুইজারল্যান্ডের ‘ক্লাইমওয়ার্কস’ অন্যতম। তারা একটি রাসায়নিক পদার্থের ফিল্টারের ভেতর দিয়ে বিশাল ফ্যানের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে বাতাস নির্গত করে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। অন্য একটি পদ্ধতি হলো, কার্বন বন্দি ও সংরক্ষণ। তবে এসব প্রযুক্তি বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলনে দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, অনুন্নত দেশের জন্য ফান্ড সৃষ্টির বিষয়টি সব সময়ই প্রাধান্য পেলেও সমস্যা হলো অধিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকারী উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে নিঃসরণ কমাবার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায় না। তাছাড়া ফান্ড পেতে দরিদ্র দেশগুলোকে অনেক জটিল মেকানিজমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। করণীয়গুলো কিন্তু সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া উচিত কার্বন নিঃসরণ কমানোয়। সেই কাজটিই বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত কপ বা জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ একমত হতে পারেননি। তারা ফান্ড বা অনুদান দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদনে চুক্তি করেন। কার্বন কমাতে নিজেদের দেশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিতে তারা দ্বিধাবোধ করেন। বৈশ্বিক এই সমস্যা শুধু দরিদ্র দেশের ভোগান্তিই বাড়াবে না। এর কমবেশি কুপ্রভাব পড়বে সব দেশেই। অথচ সেটা ঝুলন্তই থেকে যাচ্ছে কপ সম্মেলনগুলোতে। বিষয়টি এরকম যে, শরীরে ব্যথার উৎস চিহ্নিত না করে শুধু ব্যথানাশক বড়ি সেবন করে যাবার মতো। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯)। সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা অংশ নেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ফ্রান্সের মতো বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের উপস্থিতি সম্মেলনে সবিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। এই জলবায়ু সম্মেলনে ধনী দেশগুলো দীর্ঘ তেত্রিশ ঘণ্টার আলোচনার পর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করে। প্যারিস সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনে নানা অ্যাকশন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কপ-২৬ অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে সই করা দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা নিতে একমত হয়েছিল। ২০১৯ সালের শেষদিকে করোনা মহামারির উত্থানের পর এটিই সশরীরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। চারটি লক্ষ্যকে এ সম্মেলনে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। > ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যতে নামিয়ে আনতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা। > জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার করা, প্রতিরক্ষা ও সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ, অবকাঠামো তৈরি ও কৃষি ব্যবস্থাকে স্থিতিস্থাপক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। > এসব কাজ সম্পাদনের জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করার জন্য উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা রাখা। > জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করা। সম্মেলনে ‘গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন’ সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য ‘গ্লাসগো-শার্ম এল-শেইখ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন দি গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অ্যাডেপ্টেশন কার্যক্রমকে বেগবান করবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ঘুরেফিরে অ্যাডেপ্টেশনের বিষয়টিই বারবার উঠে আসছে। অ্যাডেপ্টেশনই বাংলাদেশের একমাত্র অপশন। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে এত মানুষ কোথায়-কীভাবে অ্যাডেপ্টেড হবে (তা নির্ভর করে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, তার ওপর)। অ্যাডেপশন বা খাপ খাইয়ে নিতে যে পরিকল্পনা, অর্থ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, সেই বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমাদের মিশন ও ভিশন হতে হবে। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এ সম্মেলনে একটি রুল বুক প্রণীত হয়েছিল। এই রুল বুকের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিশ্রুতিগুলো খতিয়ে দেখবেন বিশেষজ্ঞরা—এরকম কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়েছিল। কপ-২৬-এর মূল লক্ষ্য ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার আশা বাঁচিয়ে রাখা, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হলেও এটা কীভাবে পরিপূর্ণ সফলতা পাবে, তা কিন্তু তর্কাতীত নয়। খোদ কপ-২৬ সভাপতি অলোক শর্মার ভাষায়, ‘আমরা ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রার আশা বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু এর নাড়ি বড়ই দুর্বল।’ অনস্বীকার্য যে, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী ও পরাশক্তির দেশগুলো বিলাসিতায় ও আরাম-আয়েশে থেকে, পৃথিবীর সিংহভাগ ভূখণ্ডকে চরম বিপদের মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন নামের দানবের জন্ম দিয়ে। তারা জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। তারা জানতো, এই পৃথিবীটা আমাদের নয়; আমরা শুধুমাত্র একে ধার নিয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধাপে ধাপে বন্ধ করা সম্ভব, যদি জ্বালানি সাশ্রয় করা হয় এবং এমন শক্তির উৎসে রূপান্তর করা হয়, যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন দূষণ সৃষ্টি করে না। এ পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ুু, সূর্য, জলবিদ্যুৎ এবং পারমাণবিক শক্তি। এসব উৎস থেকে উৎপন্ন পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ পরিবহন, ভবন গরম রাখা এবং শিল্প প্রক্রিয়া চালানোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বনও অপসারণ করা যায়, যেমন- বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এমন কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করা, যা মাটিতে কার্বন সংরক্ষণ করে। >> মানুষ কী করতে পারে?১. গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা পরিবেশ-বান্ধব জনপরিবহনের ব্যবহার বাড়াতে পারে।২. বাড়িতে যাতে গরম বা ঠান্ডা কম ঢোকে তার ব্যবস্থা নিতে পারে।৩. মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার কমাতে পারে।৪. বিমান ভ্রমণ কমাতে পারে। সামনের কপ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নত দেশগুলো থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যা হবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সবচাইতে জরুরি পদক্ষেপ। এর কোনো বিকল্প নেই। টেকনোলজি ট্রান্সফার, নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার এবং সৌরশক্তি ব্যবহার সাময়িক সমাধান। এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এগুলোর ব্যবহার এখনো অনেকটাই সামর্থের বাইরে। অতএব কেবল ফান্ড সৃষ্টির ওপর জোর না দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধিদের প্রধান কাজ হবে, কার্বন কমাতে শিল্পোন্নত দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। সেইসঙ্গে নিজ নিজ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিরলস কাজ করে যাওয়া। লেখক: পরিবেশবিদ (সার্টিফায়েড মেম্বার, ইকো-কানাডা, ক্যালগেরি, আলবার্তা, কানাডা)। এসইউ