স্বাগত হে মৃত্যুঞ্জয়ী শান্তির দূতেরা

আহসান হাবিব বরুন বাংলাদেশের আকাশে আবারও শোকের ছায়া। তবে সেই শোকের সঙ্গে মিশে আছে গর্ব, সম্মান আর গভীর শ্রদ্ধা। সুদানের আবেই অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী ড্রোন হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষীর শহীদ হওয়ার সংবাদ জাতিকে নাড়া দিয়েছে। যারা নিজ দেশের মাটি ছেড়ে হাজার মাইল দূরে গিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের মানুষের জন্য শান্তির পতাকা বহন করেছিলেন। আজ তারা ফিরে আসছেন নিথর দেহ। তবে খালি হাতে নয়। সঙ্গে বয়ে আনছেন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগের বীরত্ব গাথা। এমন সৌভাগ্য ক\'জনের হয়। আগামীকাল সকালে ঢাকায় আনা হবে এই ছয় শহীদ শান্তিরক্ষীর মরদেহ। দেশে ফেরার পর যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে সেনানিবাস পর্যন্ত প্রতিটি স্যালুট জানিয়ে দেবে জাতির কৃতজ্ঞতা। কারণ, তারা কেবল সেনাসদস্য নন, তারা যে বাংলাদেশের মানচিত্রকে বিশ্বময় মর্যাদার আসনে বসানো মৃত্যুঞ্জয়ী শান্তির দূত। স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১৩ ডিসেম্বর সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে সংঘটিত হয় নৃশংস সন্ত্রাসী ড্রোন হামলা। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের নিষ্ঠুর প্রদর্শনীতে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। আহতদের দ্রুততার সঙ্গে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয় এবং তাদের কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে অবস্থিত আগা খান ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আহতদের মধ্যে একজন ইতোমধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। বর্তমানে সবাই শঙ্কামুক্ত। এই তথ্য আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিলেও শহীদদের শূন্যতা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন;সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম, সৈনিক শান্ত মন্ডল, রাজবাড়ীর বাসিন্দা সৈনিক শামীম রেজা, কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং গাইবান্ধার বাসিন্দা লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া।যাদের জীবন থেমে গেল শান্তিরক্ষা করতে গিয়ে। এই হামলায় আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন;কুষ্টিয়ার বাসিন্দা লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, দিনাজপুরের বাসিন্দা সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, ঢাকার বাসিন্দা করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, বরগুনার বাসিন্দা ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম, কুড়িগ্রামের বাসিন্দা সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, রংপুরের বাসিন্দা সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, মানিকগঞ্জের বাসিন্দা সৈনিক চুমকি আক্তার এবং নোয়াখালীর বাসিন্দা সৈনিক মো. মানাজির আহসান। তারা আজ শারীরিক ক্ষত সয়ে উঠছেন, কিন্তু মানসিকভাবে বহন করছেন সহযোদ্ধা হারানোর গভীর বেদনা। তবুও তারা দায়িত্ববোধে অবিচল। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নিজেই জানে যুদ্ধের বিভীষিকা, মানবিক বিপর্যয় আর শান্তির মূল্য। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে এক অনন্য মানবিক দর্শন নিয়ে হাজির হয়েছে। যেখানে অস্ত্রের চেয়ে আস্থা, শক্তির চেয়ে সহমর্মিতা, আর বিজয়ের চেয়ে জীবন রক্ষাই মুখ্য। সুদানসহ আফ্রিকা ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন না। তারা স্কুল, হাসপাতাল, পানি সরবরাহ, নারীর নিরাপত্তা-সবখানেই মানবিক সেতুবন্ধন তৈরি করেন। এই দায়বদ্ধতার পথেই তারা লক্ষ্যবস্তু হন সন্ত্রাসীদের। এই হামলা আমাদের সামনে নতুন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছে।শান্তিরক্ষা মিশনগুলো ক্রমেই আধুনিক সন্ত্রাসের মুখোমুখি। ড্রোন প্রযুক্তি সন্ত্রাসীদের হাতে উঠায় যুদ্ধের ধরন বদলে দিয়েছে। শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন কৌশল, উন্নত প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সমন্বয় জোরদার করতে হবে। এ ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা মোটেই উচিত নয় বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ বহুবারই এ বিষয়ে জাতিসংঘে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা কোনোভাবেই আপসের বিষয় হতে পারে না। সেই সঙ্গে আমি এ কথা বলতে চাই যে, শহীদ পরিবারের পাশে রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী ও সমাজকে দীর্ঘমেয়াদে দাঁড়াতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে এই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। শেষ কথা আজ যারা ফিরছেন কফিনে আবদ্ধ হয়ে তারা কিন্তু আসছেন বিজয়ীর মর্যাদায়। তাদের রক্তে ভিজে আছে শান্তির পতাকা‌। তাদের নাম লেখা থাকবে বাংলাদেশের গৌরবগাথায। তাই শোকের এই দিনে আমরা দ্বিধাহীন কন্ঠে বলতে চাই। স্বাগত হে মৃত্যুঞ্জয়ী শান্তির দূতেরা। লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।ahabibhme@gmail.com এইচআর/জেআইএম