সংসদ সদস্যদের আসল কাজ কী?

আবুল কালাম আজাদ একজন এমপির আসল কাজ কী-এই প্রশ্নটি যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে ততটাই গভীর ও অস্বস্তিকর। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ক্ষমতার চরিত্র, নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব-সবকিছুর মুখোমুখি হতে হয়। সংসদ কোনো অলংকার নয়, কোনো ব্যক্তিগত ক্লাবও নয়। সংসদ হলো জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যাদের সেখানে পাঠায়, তারা মূলত প্রতিনিধি-মালিক নন। অথচ বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংসদের ধারণাটি বহুদিন ধরেই উল্টো পথে হাঁটছে। এখানে সংসদ অনেক সময় জনগণের কণ্ঠস্বর হওয়ার বদলে ক্ষমতার প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে, আর সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার বদলে ক্ষমতার অংশীদার হতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সংসদের মূল কাজ তিনটি-আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা। আইন প্রণয়ন মানে কেবল আইন পাস করা নয়, বরং জনগণের জীবনমান উন্নত করে এমন ন্যায়ভিত্তিক, সময়োপযোগী ও মানবিক আইন তৈরি করা। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা মানে নির্বাহী বিভাগের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, ব্যয় ও কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি রাখা। আর জনগণের স্বার্থ রক্ষা মানে সংসদ সদস্যের প্রথম ও শেষ দায় জনগণের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সমস্যা সংসদে তুলে ধরা এবং সমাধানের জন্য লড়াই করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো-বাংলাদেশের সংসদে এই তিনটি কাজ কতটা গুরুত্ব পায়? বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াই অনেক সময় সংসদের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। ভোটে নির্বাচিত হোন কিংবা বিনা ভোটে-এই দুই বাস্তবতার পার্থক্য সংসদ সদস্যের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। যিনি প্রকৃত অর্থে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় নিয়ে সংসদে যান, তার মধ্যে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহির একটা বোধ থাকার কথা। কারণ তিনি জানেন, পাঁচ বছর পর আবার জনগণের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু যিনি বিনা ভোটে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বা প্রশাসনিক সহায়তায় নির্বাচিত হন, তার কাছে জনগণ অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তখন জনগণের বদলে ক্ষমতাই হয়ে ওঠে তার মূল ভরকেন্দ্র। এই বাস্তবতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কীসের পেছনে দৌড়ান-এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা দৌড়ান ক্ষমতার পেছনে, প্রভাবের পেছনে, সুযোগ-সুবিধার পেছনে। সংসদ সদস্য হওয়াকে তারা দায়িত্ব নয়, বরং বিশেষাধিকার হিসেবে দেখেন। সরকারি গাড়ি, প্রটোকল, উন্নয়ন প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার প্রভাব, নিয়োগে সুপারিশ-এসব হয়ে ওঠে তাদের দৌড়ের মূল লক্ষ্য। সংসদ সদস্যের কার্ডটি যেন অনেকের কাছে একটি সর্বময় লাইসেন্স, যার মাধ্যমে সব দরজা খোলা যায়। সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ সংসদ ভবনের চেয়ে সচিবালয়, মন্ত্রণালয় ও ক্ষমতাধর আমলাদের দপ্তরে বেশি সময় কাটান। কারণ সংসদে কথা বললে হয়তো সংবাদ শিরোনাম হবে, কিন্তু মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করলে প্রকল্প পাওয়া যায়, কমিশন পাওয়া যায়, প্রভাব বাড়ে। সংসদীয় কমিটিগুলো, যেগুলো আসলে সরকারের জবাবদিহির সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হওয়ার কথা, সেগুলো অনেক সময় ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার জায়গা হয়ে ওঠে। কে কোন কমিটির সভাপতি হবেন, কে কোন কমিটির সদস্য থাকবেন-এটা নির্ধারিত হয় যোগ্যতা বা আগ্রহ দিয়ে নয়, বরং আনুগত্য ও ক্ষমতার সমীকরণ দিয়ে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। অনেক সংসদ সদস্য সংসদে উত্থাপিত বিলগুলো পড়েন না, বোঝেন না, সংশোধনী আনেন না। দলীয় সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত-হাত তুলতে বলা হলে হাত তোলেন, নামাতে বলা হলে নামান। এখানে বিবেকের ভোট, যুক্তির বিতর্ক, জনস্বার্থের প্রশ্ন প্রায় অনুপস্থিত। সংসদ যেন একধরনের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়, যেখানে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তগুলো আনুষ্ঠানিক বৈধতা পায় মাত্র। তবে এই চিত্র শুধু সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়; এটি একটি কাঠামোগত সংকটের ফল। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা চায় না। দলীয় শৃঙ্খলার নামে সংসদ সদস্যদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়। ভিন্নমত মানেই শাস্তি, মনোনয়ন বাতিল, রাজনৈতিক মৃত্যু। ফলে সংসদ সদস্যরা জনগণের কথা বলার আগে দলীয় হাইকমান্ডের মুখের দিকে তাকান। জনগণ এখানে দ্বিতীয়, দল প্রথম। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ার পর আরেকটি যে জিনিসের পেছনে দৌড়ান, তা হলো ‘এলাকার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ’। অনেক সংসদ সদস্য নিজ নিজ এলাকায় নিজেকে সর্বময় ক্ষমতার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, উন্নয়ন দপ্তর-সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তারই তাদের লক্ষ্য। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত সবকিছু যেন তার অনুমতি ছাড়া নড়তে না পারে। এতে করে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দুর্বল হয়, জনপ্রতিনিধিত্বের বিকেন্দ্রীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়। এখানে একটি ভয়ংকর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে-সংসদ সদস্য মানেই এলাকায় ভয় ও সুবিধার সমন্বিত প্রতীক। কেউ তার বিরোধিতা করলে প্রশাসনিক হয়রানি, মামলা বা রাজনৈতিক নিপীড়নের আশঙ্কা তৈরি হয়। আবার যারা তার অনুগত, তারা পায় বিশেষ সুবিধা। এতে সমাজে ন্যায়বিচারের ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট। কারণ তাদের বৈধতার উৎস জনগণ নয়, বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। ফলে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না হয়ে তারা আরও বেশি করে ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেন। তাদের প্রধান চিন্তা থাকে-কীভাবে ক্ষমতার কাছে নিজেকে আরও প্রয়োজনীয় করে তোলা যায়, কীভাবে পরবর্তী সময়েও মনোনয়ন বা সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। এই দৌড়ে জনগণের দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা, অধিকার-সবকিছু গৌণ হয়ে পড়ে। সংসদের আসল কাজের সঙ্গে এই দৌড়ের কোনো মিল নেই। সংসদের কাজ হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রের নৈতিক কম্পাস হওয়া, কিন্তু বাস্তবে তা অনেক সময় ক্ষমতার প্রতিধ্বনি কক্ষে পরিণত হয়। সংসদ সদস্যদের প্রশ্ন করার কথা ছিল-কেন এই বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অবহেলিত, কেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, কেন মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রশ্ন তুললে অনেক সময় তাদেরই ‘অস্বস্তিকর’ বলে চিহ্নিত করা হয়। তবু এই অন্ধকারের মধ্যেও পুরোপুরি আশাহীন হওয়ার কারণ নেই। ইতিহাস সাক্ষী, সংসদ কখনোই কেবল ভবন বা সংখ্যার বিষয় নয়; এটি মানুষের মানসিকতা ও রাজনৈতিক চর্চার প্রতিফলন। যখন জনগণ সচেতন হয়, প্রশ্ন করে, জবাবদিহি দাবি করে-তখন সংসদও বদলাতে বাধ্য হয়। সংসদ সদস্যদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাস তাদের বিচার করবে তারা কতটি গাড়ি ব্যবহার করেছেন বা কতটি প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করেছেন তা দিয়ে নয়, বরং তারা জনগণের জন্য কতটা দাঁড়িয়েছেন তা দিয়ে। একজন সংসদ সদস্যের সবচেয়ে বড় দৌড় হওয়া উচিত সত্য ও ন্যায়ের পেছনে। ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু মানুষের আস্থা দীর্ঘস্থায়ী। যে সংসদ সদস্য জনগণের পক্ষে কথা বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তিনি হয়তো সাময়িকভাবে ক্ষমতার অস্বস্তি তৈরি করেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তিনিই ইতিহাসের পাতায় সম্মানিত হন। আর যে সংসদ সদস্য ক্ষমতার পেছনে দৌড়ান, তিনি হয়তো এখন সুবিধা পান, কিন্তু সময়ের আদালতে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ হন। বাংলাদেশের সংসদ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই সংসদ জনগণের হয়ে উঠবে, না ক্ষমতার ছায়া হয়ে থাকবে-এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি জনগণের ভূমিকার ওপর। সংসদের আসল কাজ ভুলে গেলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়, সমাজ ভেঙে পড়ে। আর সংসদ সদস্যরা যদি ক্ষমতার দৌড় থামিয়ে দায়িত্বের পথে হাঁটেন, তবে সংসদ আবারও জনগণের সত্যিকারের ঘর হয়ে উঠতে পারে। আবুল কালাম আজাদযুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট columnistazad@gmail.com এমআরএম/জেআইএম