নির্ধারণ হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার তারিখ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবসান হতে চলেছে নির্বাসিত জীবনের। কাটা হয়েছে উড়োজাহাজের টিকিট। হাতে পেয়েছেন ‘ট্রাভেল পাস’। এখন শুধু দেশের মাটিতে পা রাখার অপেক্ষা। ১৭ বছরের বেশি সময় পর যুক্তরাজ্য থেকে আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। তার প্রত্যাবর্তন ঘিরে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে, তেমনি নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রকাশ পাচ্ছে শঙ্কাও। মূলত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনার পরে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সব রাজনৈতিক নেতা যাতে নিরাপদে থাকে, সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কোনো আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে, সরকারের দায়িত্ব আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব আছে। জনগণের সচেতনতা জরুরি। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তারেক রহমান দেশে এলে তার নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোনো ঝুঁকির তথ্য নেই, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারেক রহমানকে পুলিশ প্রটেকশন দেওয়া হবে। এছাড়া আরও নানামুখী ব্যবস্থা থাকবে। বিমানবন্দর থেকে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার সূচনা হবে। এখনই সবকিছু বলা যাবে না।- ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির দেশে ফেরা সব সময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয়। সে কারণে আগাম প্রস্তুতি ও সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। তারেক রহমানসহ দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পুলিশ বলছে, দেশে ফেরার পর তারেক রহমান এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গমনাগমনের সময় পাবেন পুলিশ প্রটেকশনসহ বিশেষ নিরাপত্তা। এছাড়া তারেক রহমানের বাসভবন ও অফিসেও থাকবে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে তার ধারেকাছে ভিড়তে দেবে না পুলিশ। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও ছদ্মবেশে গোয়েন্দারা তারেক রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করবেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দেশের রাজনীতিতে নতুন গতি আনতে পারে। তারা আশা প্রকাশ করেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও যথাযথ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তিনি দেশে ফিরবেন। আরও পড়ুনকন্যাসহ তারেক রহমানের সঙ্গে ফিরছেন আরও ৫ জনযে কারণে ট্রাভেল পাসেই ফিরতে হবে তারেক রহমানকেমায়ের মতো বাসায় বসেই ভোটার হতে পারবেন তারেক রহমান‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট করাই পুলিশের ‘মাথাব্যথা’ সব মিলিয়ে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন কৌতূহল বাড়ছে, তেমনি নিরাপত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতির দিকেও নজর রাখছে সংশ্লিষ্ট মহল। কেবল কোনো একজন রাজনৈতিক নেতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং দেশে এমন একটি সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে।- অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তারেক রহমানের দেশে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা জানার পর তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গত সোমবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে দেশে ফেরার পর তারেক রহমানকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। নিরাপত্তায় কোথাও যেন কোনো ফাঁক না থাকে এ বিষয়টি ভালোমতো তদারকি করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক আদর্শ তদন্তের পর নিরাপত্তায় ডিউটি আরেকটি সূত্র জানায়, তারেক রহমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখার পর তাকে বহনকারী গাড়ির আগে-পিছে পুলিশ প্রটেকশন দেবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পুলিশ প্রটেকশনের গাড়িসহ তারেক রহমানের ধারেকাছে যারা ডিউটি করবেন, তাদের সিকিউরিটি ভেটিং শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ এবং পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে তদন্তের পর তারেক রহমানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএমপি। এজন্য একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তারেক রহমানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে নানামুখী তদন্ত করবে। গোয়েন্দা তদন্তে যেসব পুলিশ সদস্যের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে না, তাদের তারেক রহমানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হবে না। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও ছদ্মবেশে গোয়েন্দারা তারেক রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করবেন। মাঠে থাকবে সোয়াট টিম-বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট জানা যায়, তারেক রহমান বিমানবন্দর থেকে গুলশানে আসার পথে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওইদিন তার নিরাপত্তা উপলক্ষে মাঠে থাকবে ঢাকা মহানগর পুলিশের সোয়াট টিম, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা। তার বাসা ও অফিস ডগ স্কোয়াড দিয়ে সুইপিংয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে পুলিশ। তারেক রহমান দেশে ফেরার পর সরাসরি হাসপাতালে যাবেন নাকি বাসায় যাবেন এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো পুলিশকে কিছুই জানানো হয়নি। এ কারণে হাসপাতাল ও বাসা দুটি রুট ঘিরেই নিরাপত্তা ও ট্রাফিক পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। দেশে ফেরার আগের রাতেই এই দুই রুট ঘিরে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। এদিকে তারেক রহমানের আগমনের দিন ঢাকায় ব্যাপক লোকসমাগম হবে। বিষয়টি মাথায় রেখে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে আগাম পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সড়কে ডাইভারশন দেওয়াসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ওইদিন সব ধরনের যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত ও টোল ফ্রি করে দেওয়া চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দলের পক্ষ থেকেও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বেও আলাদা একটি টিম কাজ করবে। তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তার জন্য বাসভবন ও দলীয় অফিস প্রস্তুত করেছে বিএনপি। গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায় উঠবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই বাসার পাশেই ভাড়া করা বাসা ফিরোজায় থাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তারেক রহমানের জন্য আলাদা চেম্বার তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের ১০/সি বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বিএনপির অফিস হিসেবে। যেখান থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। চারতলা এই ভবনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে দোতলায় রয়েছে ব্রিফিং রুম। অন্য তলায় বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে গবেষণা সেল। এই বাড়ি ছাড়াও গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসাটিতে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলবে পুলিশ। সিসি ক্যামেরায় মোড়ানো থাকবে পুরো বাড়ি। অননুমোদিত কাউকে এই বাড়ির আশপাশে ভিড়তে দেওয়া হবে না। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আগামী ২৫ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সমাবেশের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে। সেই সমাবেশের মধ্য দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে যে, দেশে আর কোনো ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে পারবে না। ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, তারেক রহমানের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘তারেক রহমানকে পুলিশ প্রটেকশন দেওয়া হবে। এছাড়া আরও নানামুখী ব্যবস্থা থাকবে। বিমানবন্দর থেকে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার সূচনা হবে। এখনই সবকিছু বলা যাবে না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে আলোচনা চলছে, তা বিবেচনায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেকাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং দলীয় পর্যায়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বাকি অংশ পূরণ করা যেতে পারে।’ তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কেবল কোনো একজন রাজনৈতিক নেতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং দেশে এমন একটি সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে।’ ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও একটি গুণগত পরিবর্তন আসা প্রত্যাশিত। এ উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম আরও কার্যকর ও জনআস্থাভিত্তিক হবে।’ টিটি/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম