আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্র নামের যে সংগঠনটি আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলেছি, তার মূল ভিত্তি হওয়ার কথা জনগণ। রাষ্ট্রচক্র ঘুরবে মানুষের অধিকার, কল্যাণ, নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা বড়ো নির্মম-আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ প্রশাসন যখন নষ্ট হতে শুরু করে, তখন রাষ্ট্রের কাঠামোও ভেঙে পড়ে, আর জনগণের আস্থা ঝরে যায় বালুর মতো। আস্থা শব্দটি দেখতে ছোট হলেও এর ভাঙন যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা টের পাওয়া যায় তখনই যখন মানুষ মনে করে এ রাষ্ট্র আমার নয়, এ প্রশাসন আমার পাশে নেই। এই হতাশা থেকে জন্ম নেয় ক্ষোভ, ঘৃণা, বিরক্তি এবং শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রবিমুখতা। ইতিহাস বলে, একটি রাষ্ট্র তখনই বিপদে পড়ে, যখন তার জনগণ প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকে সন্দেহ, ঘৃণা কিংবা অবহেলার চোখে। আজ বাংলাদেশ সেই দুঃসময়ের এক কঠিন মোড়ে দাঁড়িয়ে। জনগণের চোখে প্রশাসনের ভাবমূর্তি আজ অত্যন্ত করুণ অবস্থায়। দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডার কারসাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি প্রকল্পে টাকা লুট, প্রভাব খাঁটিয়ে আইনের অপব্যবহার- এসব যেন আমাদের প্রশাসনের নতুন পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই প্রশাসনই হওয়ার কথা ছিল জনগণের সেবক। সেবক নয়, বরং অনেকের আচরণে প্রকাশ পায় শাসকের ভাব। ঔপনিবেশিক আমলের সেই দফতর সংস্কৃতি যেখানে জনগণ ছিল নিচে, কর্মকর্তা ছিল ওপরে-আজও রয়ে গেছে আমাদের প্রশাসনের রক্তকণিকায়। সময় বদলেছে, স্বাধীনতা এসেছে, প্রযুক্তি এসেছে, উন্নয়নের জোয়ার বইছে-কিন্তু প্রশাসনিক মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রেই সেই শতবর্ষের পুরোনো ‘শাসক-প্রজা’ কাঠামোর বাইরে বেরোতে পারেনি। এই অবস্থার কারণে নাগরিকরা আজ ক্ষুব্ধ, হতাশ, ক্লান্ত। Transparency International Bangladesh (TIB)-এর জরিপ বলছে, সরকারি সেবা পেতে দেশের প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ঘুষ দিতে বাধ্য হন। এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়; এটি মানুষের রক্তক্ষরণ, বঞ্চনা, ঘুচে না ফেরা অপমান। জন্মনিবন্ধন, ভূমি রেকর্ড, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, হাসপাতালের বিছানা, সরকারি সহায়তা, প্রকল্পের কাজ, টেন্ডার-জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ঘুষ এক অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। নাগরিকরা মনে মনে মেনে নিয়েছে- ‘ঘুষ না দিলে কাজ হয় না।’ এ যেন আমাদের রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সিলেবাসে যুক্ত হয়ে গেছে দুর্নীতির পাঠ। আর এই পাঠের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় আমরা সবাই ফেল করছি। দুর্নীতির এই বিস্তৃত চিত্র কেবল প্রশাসনের ভেতরের সমস্যাই নয়; এটি পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার নৈতিকতার অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। যখন কর্মকর্তারা ঘুষকে ‘অফিসিয়াল ফি’ হিসেবে চালু করেন, তখন নাগরিকদের চোখে সততার মূল্য পড়ে যায়। ছেলে-মেয়েরা দেখে- সৎ মানুষ কষ্ট পায়, দুর্নীতিবাজ প্রসন্ন জীবন কাটায়। তরুণদের মধ্যে সততা দুর্বলতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সমাজ তখন মেধা ও পরিশ্রম নয়, চাতুর্য ও দুর্নীতিকে পুরস্কার দেয়। ফলে একটি পুরো প্রজন্ম শিখে যায়-ঘুষ ছাড়া উন্নতি নেই, সুপারিশ ছাড়া চাকরি নেই, ক্ষমতার ছায়া ছাড়া নিরাপত্তা নেই। এ সংস্কৃতি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে ভেতর থেকে। সবচেয়ে বড়ো ভয়-এই সংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্তার লাভ করে। দুর্নীতি একটি দেশের অর্থনীতিকেও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে টাকার পাহাড় লোপাট হয়। রাস্তা নির্মাণ হয়, কিন্তু বছর পেরোনোর আগেই তা ভেঙে পড়ে; সেতু বানানো হয়, কিন্তু মানহীন উপকরণের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে; স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণ হয়, কিন্তু প্রকৃত কাজ হয় অর্ধেক। উন্নয়ন কাগজে থাকে-মাঠে থাকে দুর্নীতির ফাঁদ। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ যদি প্রশাসনিক দুর্নীতি অর্ধেকে নামাতে পারে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ২ শতাংশ বাড়তে পারে। অর্থাৎ দুর্নীতি শুধু নৈতিক সমস্যা নয়, এটি উন্নয়নহীনতার সবচেয়ে বড় বাধা। প্রশাসনের এই পরিত্যক্ত অবস্থা জনগণের আস্থা কেড়ে নিয়েছে। যখন মানুষ দেখে, অভিযোগ দিলে কোনো ব্যবস্থা হয় না; ঘুষ না দিলে ন্যায্য কাজও হয় না; অন্যায়ের বিচার নেই; অসৎ কর্মকর্তারা বছর পর বছর পদোন্নতি পাচ্ছেন; তখন তাদের মনে ক্ষত তৈরি হয়। মানুষের কর দেওয়ার আগ্রহ কমে যায়, আইন মানার ইচ্ছা কমে যায়, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা কমে যায়। একসময় তারা বিশ্বাস করে- ‘এ রাষ্ট্র আমাদের নয়; এখানে সবকিছু চলে প্রভাব আর টাকার জোরে।’ এই বিশ্বাস হারানোই প্রশাসনের সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যর্থতা। রাষ্ট্রের ভিত্তি ভেঙে পড়ে সেখানেই। দুর্নীতি বাড়ে তখনই যখন অপরাধীরা শাস্তি পায় না। শাস্তির অনুপস্থিতিই দুর্নীতির খাদ্য। আমাদের প্রশাসনের বড়ো সমস্যা হলো জবাবদিহিতার অভাব। বছরের পর বছর ধরে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, কিন্তু তারা টিকে থাকেন ক্ষমতার ছত্রছায়ায়। সরকারি দপ্তরগুলোতে Performance Audit বাধ্যতামূলক নয়; সম্পদের বিবরণ অনেক সময়ই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ; দুর্নীতি দমন কমিশন প্রায়শই শক্তিহীন; আর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ফলে জনগণ ভাবে- ‘এই দেশে দুর্নীতির বিচার হয় না।’ কিন্তু সমাধানহীন কোনো সমস্যা নেই। প্রযুক্তি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে। ই-গভর্নেন্স, অনলাইন আবেদন, ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-টেন্ডারিং-এসব ব্যবস্থা কর্মকর্তা-নাগরিকের সরাসরি যোগাযোগ কমিয়ে দুর্নীতির পথ রুদ্ধ করতে পারে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সেবা দেওয়ার আইন থাকলে ঘুষের সুযোগ কমে। অনলাইন অভিযোগ প্ল্যাটফর্ম থাকলে নাগরিকরা দায়বদ্ধতার চর্চা করতে পারে। প্রযুক্তি শুধু সেবা সহজ করে না- এটি এক অদৃশ্য নজরদারি তৈরি করে, যা দুর্নীতিকে কঠিন করে তোলে। তবে দুর্নীতি কেবল আইন দিয়ে থামে না। এটি থামাতে প্রয়োজন মানসিকতা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন। প্রশাসনের প্রশিক্ষণে নৈতিক শিক্ষা যুক্ত করতে হবে। কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে-তারা জনগণের কর্মচারী, শাসক নন। সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পুরস্কার এবং সম্মান দিতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে, বদলি বা পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া একটি উন্নত রাষ্ট্র কল্পনাতীত। গণমাধ্যম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা অনেক সময় নিজের জীবন বিপন্ন করে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন। কিন্তু সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে তিনি কথা বলবেন কীভাবে? নাগরিক সমাজেরও ভূমিকা রয়েছে। সুশীল সংগঠন, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনরা জনগণকে সচেতন করতে পারে, চাপ তৈরি করতে পারে, প্রশাসনকে পর্যবেক্ষণে রাখতে পারে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও ভূমিকা আছে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মই সততা, ন্যায়, দায়িত্ববোধের শিক্ষা দেয়। যদি কর্মকর্তারা এসব মূল্যবোধ মেনে চলতেন, তবে প্রশাসনের চিত্র অন্যরকম হতো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানসিকতা গঠন করতে হলে স্কুল-কলেজেও মূল্যবোধ শিক্ষা জরুরি। ছোট থেকেই শিশুদের শেখানো উচিত-সততা শক্তি, দুর্নীতি লজ্জা। প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। উপজেলা বা পৌরসভায় অংশগ্রহণমূলক বাজেট সভা হতে পারে, Citizen Charter বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন মানুষ বুঝতে পারে তাদের কর কোথায় ব্যবহার হচ্ছে। এটি স্বচ্ছতা তৈরি করে এবং জনগণের আস্থা বাড়ায়। অবশ্যই মনে রাখতে হবে-জবাবদিহিতা মানে ভয় সৃষ্টি করা নয়। বরং এটি দায়িত্ববোধ তৈরি করে। এমন প্রশাসন চাই, যেখানে সৎ কর্মকর্তা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন, যেখানে ন্যায়পরায়ণতা পুরস্কৃত হয়। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ বৃত্তিকারীরা যেন জানে-দোষ করলে শাস্তি হবেই। এমন বার্তা প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশ দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। সিঙ্গাপুর, রুয়ান্ডা, দক্ষিণ কোরিয়া-সবাই একসময় দুর্নীতিতে ডুবেছিল। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক, শক্তিশালী আইন, স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনিক ব্যবস্থাই আজ তাদের উন্নতির মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশও চাইলে পারে। আমাদের প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক শুদ্ধতা এবং জনগণের দাবি। দুর্নীতি একটি জাতিকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও ধ্বংস করে। ঘুষ মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে, কর্মকর্তাদের বিবেককে বিকলাঙ্গ করে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। একটি সৎ, জবাবদিহিমূলক, মানবিক প্রশাসন ছাড়া উন্নয়ন কখনোই টেকসই হতে পারে না। মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে প্রশাসনের মনোভাব বদলাতে হবে, সংস্কৃতি বদলাতে হবে, কাঠামো বদলাতে হবে। দরকার প্রস্তুত ও সত্যিকারের রিফর্ম। শেষ কথা একটাই- যেদিন এই দেশের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আন্তরিকভাবে অনুভব করবেন, ‘আমি জনগণের কর্মচারী, আমি সেবক’- সেদিন আমাদের রাষ্ট্র পাল্টে যাবে। দুর্নীতি কমবে, ঘুষের সংস্কৃতি ভাঙবে, আর জনগণের আস্থা ফিরে আসবে রাষ্ট্রের প্রতি। একটি সৎ প্রশাসনই পারে বাংলাদেশকে প্রকৃত উন্নয়ন, ন্যায় ও মানবিকতার পথে এগিয়ে নিতে। দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে সেই দিন থেকে, যেদিন কর্মকর্তারা মনে করবেন- সেবা দেওয়া তাদের দায়িত্ব, অধিকার নয়। আবুল কালাম আজাদযুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট এমআরএম/জেআইএম