দাবি আদায়ে শুল্ক কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ও পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা সংকটের মধ্যেও ২০২৫ সালে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। আগের বছরের তুলনায় বন্দরে জাহাজ আসার সংখ্যাও বেড়েছে। তবে বন্দর ও বেসরকারি অফডক-উভয় ক্ষেত্রেই রফতানির চেয়ে আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে তুলনামূলক বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখতে বন্দরের নৌ চ্যানেলের নাব্যতা বাড়ানো এবং জেটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনে জোর দিতে হবে।দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমদানি–রফতানি বাণিজ্যে বড় কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেললেও বছরের মাঝামাঝিতে শুল্ক কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ও পরিবহন ধর্মঘটে কিছুটা চাপের মুখে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। তবে সেই জটিলতা কাটিয়ে দ্রুত ছন্দে ফিরে আসে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ৩৩ লাখের বেশি কনটেইনার এবং ১৩ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন কার্গো পণ্য। একই সঙ্গে বন্দরে ভিড়েছে ৪ হাজার ৩০০টিরও বেশি জাহাজ, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। আরও পড়ুন: রেলের ইঞ্জিন সংকটে বিপর্যয়ের মুখে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের কনটেইনার পরিবহন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য কমোডর আমিন আহমেদ আবদুল্লাহ বলেন, ২০২৫ ক্যালেন্ডার ইয়ারে জাহাজ, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং-সব ক্ষেত্রেই আগের বছরের তুলনায় নতুন রেকর্ড হয়েছে। এরই মধ্যে চার হাজারের বেশি জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। কার্গোর ক্ষেত্রে ১৩ কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক পণ্য এবং ৩৩ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্পন্ন হয়েছে। অর্থবছর শেষে এই সংখ্যা ৩৪ লাখ কনটেইনারে পৌঁছাবে। এই সাফল্যের পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন বড় ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, বন্দরের গেট ও পিয়ারসাইড অপারেশন অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। কাস্টমসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সমন্বয় করে ইয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা দূর করে উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেয়ার ফলেই এই নতুন মাইলফলক স্পর্শ করা সম্ভব হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি দেশের ২১টি বেসরকারি অফডকও বছর শেষ হওয়ার আগেই কনটেইনার ও বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এসব অফডকে বছর শেষে রফতানিতে প্রায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং আমদানিতে প্রায় ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব বলেন, ২০২৪ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ও বেসরকারি অফডকগুলোকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে পরিবহন ধর্মঘট ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি উল্লেখযোগ্য। তবে এসব বাধা অতিক্রম করেই এগিয়ে চলছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। তিনি আরও বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বাণিজ্যের ধারাবাহিকতার কারণে আমদানি ও রফতানি-উভয় ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি এসেছে। তবে রফতানির তুলনায় আমদানিতে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে, কারণ দেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। স্টেকহোল্ডারদের নিরলস প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীলতার ফলেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, প্রায় ৩৯ বছর পর ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে গিয়ে নানা জটিলতার মুখে পড়তে হয়েছে। ব্যবহারকারীদের একটি অংশ বলছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এ কারণে ট্যারিফ বাড়ানোর পাশাপাশি সেবার মান বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন তারা। বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান বলেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত কিংবা ভিয়েতনামের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের খরচ বেশি। ব্যবহারকারীরা বেশি অর্থ পরিশোধ করলেও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সেবার উন্নতি প্রত্যাশিত হারে হচ্ছে না। মূল্য বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেবার মানে দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, দেশের আমদানি–রফতানি বাণিজ্যের স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের নৌচ্যানেলে নিয়মিত ড্রেজিং এবং জেটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে নাব্য সংকট কাটিয়ে অন্তত ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে জিসিবির মতো ইয়ার্ডে গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম স্থাপন জরুরি। আরও পড়ুন: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গতি ফিরেছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে রেডিয়্যান্ট শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, নাব্য সংকট নিরসনে ড্রেজিং কার্যক্রম নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে হবে, যাতে বড় জাহাজ সহজে জেটিতে ভিড়তে পারে। পাশাপাশি জিসিপি ইয়ার্ডে যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে অনেক সময় প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স পাওয়া যাচ্ছে। বন্দরের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ রয়েছে। তাই যন্ত্রপাতি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণে ধারাবাহিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যন্ত্রপাতির ঘাটতি দূর করা গেলে ২০২৬ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমান সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আরও শক্ত অবস্থানে পৌঁছাবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বন্দরের সুনাম আরও বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন শফিকুল আলম জুয়েল। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯৩ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বছরে এর আর্থিক পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক শিপিং সাময়িকী লয়েড লিস্টের হিসাবে, বিশ্বের ব্যস্ততম একশটি বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৮তম।