ভারত-পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি হামলা উত্তাপ ছড়ায় অঞ্চলজুড়ে

চলতি বছর বিশ্ববাসী স্বল্পমেয়াদি যেসব সংঘাত দেখেছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তার একটি। মাত্র চারদিন স্থায়ী হলেও এই যুদ্ধে পুরো এশিয়াজুড়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হামলা আর পাল্টা হামলা প্রতিবেশী চিরবৈরী দেশ দু’টির মধ্যকার দ্বন্দ্বে যোগ করে নতুন মাত্রা।ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাত ছিল কয়েক দশকের মধ্যে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা। এ সংঘাতে এমন ধরনের সামরিক পদক্ষেপ দেখা গেছে যা ভৌগোলিক পরিসর, ব্যবহৃত অস্ত্রব্যবস্থা এবং তার প্রভাবসহ সব ক্ষেত্রেই আগের সীমা অতিক্রম করেছে। সংকটের অবসান ঘটে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে, যেখানে প্রধান ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই ঘটনাকে ঘিরে বিপুল মাত্রায় ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, যা গত ৭ থেকে ১০ মে’র মধ্যে আসলে কী ঘটেছিল তা স্পষ্টভাবে বোঝা কঠিন করে তোলে। সংঘাতের সূচনা চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাম এলাকায় এক ভয়াবহ ‘সন্ত্রাসী হামলা’র জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের শুরু হয়। এ হামলায় ২৬ জন পর্যটক প্রাণ হারান। ভারত সরকার এ হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করে এবং এতে ইসলামাবাদের যোগসূত্র আছে বলে অভিযোগ করে। অন্যদিকে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, এর সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়ে তাতে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক বলে উল্লেখ করেন দেশটির কর্মকর্তারা। ভারত হামলার জবাবে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে, নিজেদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে, ভিসা পরিষেবা বন্ধ করে দেয় এবং সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে। প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, আকাশসীমা ও সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে এবং এরপর সিমলা চুক্তি স্থগিত করে। ২৪ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তে গুলিবর্ষণ এবং মাঝেমধ্যে কামানের গোলা নিক্ষেপের পাশাপাশি বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।  আরও পড়ুন: ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধের মেয়াদ বাড়ালো পাকিস্তান পূর্ণমাত্রার হামলা-পাল্টা হামলা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে ৭ মে ভোররাতে পাকিস্তানে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ভারত। এই অভিযানের নাম দেয়া ‘অপারেশন সিন্দুর’। ভারত দাবি করে, ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান’ হিসেবে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড ও পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীরের ৯টি শহরে মোট ২৪টি হামলা চালানো হয়েছে। জানায়, পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলা চালানো হয়েছে। ভারতের মতে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈয়বাকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। আর পাকিস্তান জানায়, ভারতীয় হামলায় মসজিদসহ বেসামরিক এলাকা লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, যার ফলে ৩১ জন পাকিস্তানির প্রাণহানি ঘটেছে। জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহার স্বীকার করেন, বাহাওয়ালপুরের জামিয়া মসজিদ সুবহানআল্লাহ-এ গোষ্ঠীটির সদর দফতরে ভারতের বিমান হামলায় তার পরিবারের ১০ সদস্য এবং তার চার সহযোগী নিহত হন। এই হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ এবং ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা পুঞ্চে ব্যাপক মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। এটিকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ গোলাবর্ষণ বলে মনে করা হয়। ভারত দাবি করে, হামলায় একজন সেনা এবং ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। এছাড়া ৪৩ জন আহত, ৩১টি স্কুল, শত শত বাড়িঘর এবং একটি শিখ মন্দির ধ্বংস হয়েছে। ১০ মে পাকিস্তান বেশ কয়েকটি ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে অভিযান শুরু করে, যার নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস’। ভারতও পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ‘অপারেশন সিন্দুর’ অব্যাহত রাখে। এই সংঘর্ষ দেশ দু’টির মধ্যে প্রথম ড্রোন যুদ্ধের সূচনা করে।  আরও পড়ুন: কাশ্মীর কখনো ভারতের ছিল না এবং ভবিষ্যতেও হবে না: জাতিসংঘকে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি চারদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই ঘোষণা করে যে তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, যা ১০ মে বিকেল ৫টা থেকে কার্যকর হয়। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর পাকিস্তান সরকার ১০ মে তারিখটিকে ‘ন্যায্য যুদ্ধের দিন’ হিসেবে ঘোষণা করে। পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি ভারতের প্রথম দফা অভিযানে পাকিস্তানের অন্তত পাঁচটি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, হামলায় অন্তত ৬৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ২০০ জনের বেশি আহত হন। ইসলামাবাদ, লাহোর ও কোয়েটা শহরে স্কুল, আবাসিক এলাকা এবং একটি রেলস্টেশন লক্ষ্য করে হামলা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেনা সদস্যদের মধ্যে ১৮ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ড্রোন ঘাঁটি এবং রাডার স্থাপনা। ভারতের ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তানের পাল্টা অভিযানে ভারতের ক্ষতি আরও বিস্তৃত। পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের পাঁচ থেকে সাতটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে প্রথমে এটি অস্বীকার করা হলেও পরে কার্যত স্বীকার করে নেয়া হয়। যদিও কয়টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছিল, তার সঠিক সংখ্যা জানায়নি দেশটি।   যুদ্ধবিমান ধ্বংসের পাশাপাশি ভারতীয় ভূখণ্ডে অন্তত ২০টি’র বেশি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হেনেছে বলে দাবি করে ইসলামাবাদ। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উধমপুর ও শ্রীনগর বিমান ঘাঁটিতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শ্রীনগরে ২০ সেনা নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আদমপুরে একটি এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি করে পাকিস্তান। এছাড়া চণ্ডীগড়ের একটি অস্ত্রভাণ্ডার, পাঠানকোট ও বাথিন্ডা বিমানঘাঁটি এবং উরি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারও আক্রান্ত হয়েছে।  আরও পড়ুন: ৮৫০ ড্রোন কিনছে ভারত, ‘অশনি প্লাটুন’ গঠনের পরিকল্পনা কেন? পরবর্তী পরিস্থিতি ও আশঙ্কা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এই সংঘাতের রেশ এখনও রয়ে গেছে। উভয় পক্ষের মধ্যে বাগযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। দিল্লি ও ইসলামাবাদে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ পরিস্থিতিকে আবারও অস্থিতিশীল করে তুলেছে, যা নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে।