ওসমান হাদি হত্যা: শুটার ফয়সাল ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব ঘিরে রহস্য

ইনকিলাম মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান ওসমান হাদিকে হত্যার তিন মাস আগে শুটার ফয়সাল ও তার স্ত্রী দুটি ব্যাংক হিসাবে জমা দেয় ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর হত্যার এক মাস আগে একইভাবে জমা হয় আরও সাড়ে ৬৫ লাখ টাকা। পরে মিশন বাস্তবায়নের আগে ৬৫ লাখ টাকা বাদে বাকি অর্থ তুলে নেয় তারা। হত্যাকাণ্ডের আগে এত বড় অঙ্কের অর্থ কেন লেনদেন করা হয়েছিল-এ বিষয়টি এখন খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।সিআইডি বলছে, ফয়সাল এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের অবৈধ লেনদেনের উৎস ও উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন, অর্থাৎ গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদিকে গুলি করার পর থেকেই আলোচনায় আসে শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ। হত্যাকাণ্ডে তার নাম আসার পরপরই আদালতের নির্দেশে ফয়সালের সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়। ফয়সালকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি তার স্ত্রী সামিয়া ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে অর্থের লেনদেনের তথ্য খুঁজতে নামে সিআইডি। অনুসন্ধানে ১৪টি ব্যাংকে ফয়সাল ও সংশ্লিষ্টদের ৫৩টি হিসাবের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব হিসাবে ২০১৭ সাল থেকে গত আট বছরে মোট ১২৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আরও পড়ুন: ওসমান হাদি হত্যা: নতুন যে তথ্য দিলেন ডিবি প্রধান এর মধ্যে ব্যাংক এশিয়ার আদাবর রিং রোড শাখাতেই পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি-১৯টি হিসাব, যেখানে ফয়সাল ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ক্যামেরার সামনে কথা বলতে না চাইলেও শাখা ব্যবস্থাপকের দাবি, এসব হিসাবের বেশিরভাগই বর্তমানে সচল নয়। তবে আট বছরে ১২৭ কোটি টাকার লেনদেনের পাশাপাশি ওসমান হাদিকে হত্যার ঠিক আগের সময়ের লেনদেন ঘিরেই বাড়ছে প্রশ্ন। হত্যার তিন মাস আগে ফয়সাল ও তার স্ত্রী দুটি ব্যাংক হিসাবে জমা দেন ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর হত্যার এক মাস আগে জমা হয় আরও সাড়ে ৬৫ লাখ টাকা। পরে মিশন বাস্তবায়নের আগে আগে ৬৫ লাখ বাদে বাকি টাকা তুলে নেয় তারা। হত্যার আগে এত টাকা উত্তোলনের কারণ কী? সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবাগত উল্লাহ বলেন,বিষয়টি অত্যন্ত গভীরভাবে তদন্ত করছে সিআইডি। এর পেছনে ‘বিহাইন্ড দ্য স্ক্রিন’ কোনো বড় গ্রুপ জড়িত ছিল কি না, কারা কোথা থেকে টাকা পেয়েছে, পুরো ঘটনার মিশন ও ভিশন কী-এসব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সবকিছু উদ্ঘাটনে কাজ চলছে এবং যথাসময়ে তা প্রকাশ করা হবে। সিআইডির অনুসন্ধানে পাওয়া ৫৩টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে ২২টি ফয়সালের মালিকানাধীন আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে। ব্যাংক হিসাবের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে লিডস ট্রেইনিং অ্যান্ড কনসালটিং লিমিটেডের কার্যালয় থাকার কথা। তবে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দেড় বছর আগেই প্রতিষ্ঠানটি গুটিয়ে নিয়েছেন ফয়সাল। স্থানীয়রা জানান, প্রতিষ্ঠানটি মূলত স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা এ ধরনের প্রশিক্ষণমূলক কাজ করত। ট্রেনিংয়ের মতো কার্যক্রম চালু ছিল, তবে প্রায় এক বছর ধরে সেখানে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। আরও পড়ুন: ওসমান হাদিকে হত্যা: প্রধান আসামি ফয়সালের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রাজধানীর আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিংয়ে ফয়সালের অ্যাপল সফট আইটি, আইকন সফটওয়্যারসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পাওয়া যায়। তবে ওই সব ঠিকানায় গিয়েও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। এলাকাবাসীরা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে কী ধরনের কাজ করত, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই কারোরই। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে কাজ চালাত। তবে গত বছরের ডিসেম্বরের দিকে টাকা-পয়সা নিয়ে একটি ঝামেলার কথা শোনা যায়। পরে ফেব্রুয়ারিতে ওই জায়গা নতুন করে ভাড়া দেয়া হয়। সিআইডি জানায়, ফয়সাল এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবার অবৈধ লেনদেনের তথ্য খুঁজে বের করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবাগত উল্লাহ বলেন, হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহযোগীদের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৫৩টি হিসাব শনাক্ত করা হয়েছে। এসব হিসাবে ১২৭ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা স্থিতি রয়েছে, যা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আইনি প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু করা হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের জন্য রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে হাদিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে ১৮ ডিসেম্বর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাদি। ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় ফয়সাল করিম মাসুদ নামে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, ফয়সাল করিম সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেছেন। এ ঘটনায় ফয়সাল করিমের মা–বাবা, স্ত্রী, শ্যালকসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে হত্যা মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল করিম বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে গেছেন, নাকি দেশে আছেন-এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।