করুণা দিদির কথা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল।— কী বললে? আমাকে যেতে হবে?— হ্যাঁ, তোকেই। তুই না গেলে আর কে যাবে?আমি বললাম, কিন্তু দিদি, আমি তো শিল্পী মানুষ। ছবি আঁকি, গান গাই। বিয়ের পাত্র-পাত্রী দেখার এসব বিষয়ে আমার কোনো দখল নেই।— সেইজন্যেই তো পাঠাচ্ছি। করুণা দিদির গলায় এমন একটা জেদ ফুটে উঠলো যে, বুঝলাম আর পালানো যাবে না। — সংসারী মানুষ দেখলে কনের রূপ দেখবে, যৌতুক দেবার সক্ষমতা দেখবে, বংশমর্যাদা দেখবে। তুই শিল্পী, তুই দেখবি মেয়েটার মনটা। ওর চোখে কী আছে। ওর হাসিতে কী আছে।আমি হাসলাম। বললাম, দিদি, তুমি তো আমাকে দিয়ে কবিতা লেখাতে চাইছো।— তাই লিখবি। করুণা দিদি বললেন। যদি মনে হয় মেয়েটার মধ্যে কবিতা নেই, তা হলে চলে আসবি। আমার ভাইয়ের জন্যে এমন মেয়ে চাই যে নিজেই একখানা কবিতা। করুণা দিদির সঙ্গে আমার পরিচয় আশ্চর্যরকম। তিনি পেশায় আইনজীবী, মামলা লড়েন হাইকোর্টে। আর আমি একটা বেসরকারি সংস্থায় গ্রাফিক ডিজাইনার। পেশাটা শুধু পেশাই। রোজগেরে দায় থেকে। আসল নেশা শিল্পচর্চা। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে, মা গ্রামে থাকেন। আমি একা থাকি ঢাকায়, একটা ভাড়াবাড়ির দোতলার ঘরে। করুণা দিদি থাকেন তেতলায়। একদিন লিফট বন্ধ থাকায় সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমি ধরে ফেললাম। তারপর থেকেই স্নেহের এই সম্পর্ক। করুণা দিদির পরিবার তার একমাত্র ভাইকে নিয়ে। তার স্বামী বহু বছর আগে বিদেশে চলে গেছেন, ফিরে আসেননি আর। ছেলেমেয়ে নেই। ভাই শাওনকে নিয়েই তার সংসার। শাওন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রভাষক। একটা শান্ত গাম্ভীর্য আছে ওর চোখেমুখে। দেখেই বোঝা যায়, এমন মানুষ যে বই নিয়ে থাকেন, দুনিয়াদারি বোঝেন কম। গবেষণা করছেন মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিয়ে। খুবই গম্ভীর, খুবই চুপচাপ একটা ছেলে। কথা বলে কম, হাসে আরও কম। সারাদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকে। করুণা দিদি বলেছিলেন, ওর বিয়ে দিতেই হবে অমিয়। তুই গিয়ে মেয়ে দেখে আয়। ওকে এখনই পাঠাবো না। তোর ওপর আমার ভরসা ষোলাআনা। তুই ‘হ্যাঁ’ বললেই এগোবো। এভাবে আর চলতে পারে না। শাওনের দিকে চেয়ে দেখ! মানুষটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।শাওন হাসি চেপে বলেছিল, দিদি, বিয়ে করলেই কি মানুষ সবুজ হয়ে ওঠে?— হ্যাঁ, হয়। করুণা দিদি বিরক্তিভরে বলেছিলেন।— তুই’ই ওর জন্য মেয়ে দেখবি অমিয়।আমি আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু করুণা দিদি শোনেননি। বলেছিলেন, আমি চিনি মেয়েটাকে। ওর নাম রোদেলা। আমার এক মামলায় ওর বাবার সঙ্গে পরিচয়। স্কুলশিক্ষক। মেয়েকে একবার দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল এই মেয়ে শাওনের জন্যই তৈরি।— কিন্তু দিদি!— কিন্তু-টিন্তু নেই। তুই যাবি। করুণা দিদি আমার হাতে একটা ঠিকানা লেখা কাগজ গুঁজে দিয়েছিলেন। বাসে চড়ে যাচ্ছি রংপুর। শীতের বিকেল, জানালা দিয়ে আসছে হালকা রোদ। কমলা রঙের রোদ। এমন একটা রোদ; যার কোনো তীব্র উত্তাপ নেই, শুধু একটা আদুরে ওম জড়ানো করুণ মায়া ছড়িয়ে দেয় চারপাশে।রোদেলা। কী শ্রুতিমধুর আর শিল্পিত নাম। রোদেলা মানে তো সূর্যের উজ্জ্বল আলো।আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি, ঢাকা শহরটা চলে যাচ্ছে পেছনে। ছোট ছোট দোকান, চায়ের স্টল, স্কুল ফেরত ছেলেমেয়ে। একটা মেয়ে রিকশায় বসে বই পড়ছে। আরেকটা মেয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে, হাসছে। হঠাৎ মনে হলো, আমি কী করতে যাচ্ছি? একটা মেয়েকে দেখতে যাচ্ছি, যেন সে একটা পণ্য। মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। রাস্তায় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে মনে ভেসে উঠল একটি কাল্পনিক মেয়ের মুখ। আগে থেকেই সাজানো হয়েছে তাকে, তারপর আত্মীয়রা ঘিরে বসে নির্দেশ দিচ্ছে—কীভাবে ঢুকতে হবে, কীভাবে বসতে হবে মাথা নিচু করে, কীভাবে জবাব দিতে হবে নিষ্ঠুর পরীক্ষকের প্রতিটি প্রশ্নের। ভয়ে দুশ্চিন্তায় চোখ ভিজে গেছে মেয়েটির, বুক কাঁপছে, ঘামে গলে যাচ্ছে সাজপ্রসাধন। এই সমাজে জন্মানোর অপরাধে চরম অপমানের মুহূর্তের অপেক্ষা করছে সে—বাইরে পায়ের শব্দ শুনলেই বুক থেমে যাচ্ছে। সত্যি, কী নিষ্ঠুরতা! দেশ এত বদলালো, কিন্তু এই প্রথাটা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। হয়তো আজকাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রূপ দেখা হয় না, কিন্তু বিচার হয় নির্লজ্জভাবে। সার্টিফিকেট দেখানো হয়, চাকরি করবে না করবে, সবার সাথে মিলে চলতে পারবে কি না, রান্না জানে কি না—বহু প্রশ্নে জর্জরিত করা হয়। সমস্ত প্রক্রিয়াটার মধ্যে একটা বর্বরতা আছে—যেন প্রকাশ্য হাটে দাসি বিক্রি হচ্ছে। কী যে বিশ্রী লাগছিল! যখন বেরিয়েছিলাম; তখন হঠাৎ পাওয়া অভিভাবকত্বের গর্বে মন কিছুটা উৎসাহিত ছিল। কিন্তু গাড়ি যতই এগোচ্ছে, ততই খারাপ লাগাটা ঝেঁকে বসছে। না, ঠিক হয়নি আসা। বাস থেমে গেল। নামতে হবে এখানে।ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পৌঁছলাম একটা পুরোনো বাড়িতে। দোতলা বাড়ি, নিচে একটা বইয়ের দোকান। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বেল বাজালাম।দরজা খুলে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা। মুখে একটা শান্ত হাসি।— আসুন, আসুন। করুণা দিদি ফোন করে জানিয়েছেন। আমি অরুণ ভৌমিক।আমি ঢুকলাম। সাদাসিধে বসার ঘর, জাঁকজমকের চেয়ে প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য বেশি। তিনদিকের তিনটি বুকশেলফে বই ঠাসা—সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, হুমায়ূন আজাদ, আহমদ ছফা থেকে ফুকো পর্যন্ত।দেওয়ালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয়নুল আবেদিনের স্কেচ, বাকি কয়েকটা রবীন্দ্রনাথ আর বিদেশি চিন্তাবিদদের ছবি। ঘরটা ছোট কিন্তু পরিচ্ছন্ন। জানালা দিয়ে আসছে সেই কমলা রঙের রোদ।— বসুন। অরুণবাবু বললেন। চা খাবেন?— না না, থাক।— করুণা দিদি বলেছেন আপনি শিল্পী। ছবি আঁকেন।আমি একটু লজ্জা পেলাম। বললাম, একটু আধটু করি। পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার।— বাহ্। অরুণবাবু বললেন। আমার মেয়েও ছবি আঁকে। তবে সে পড়াশোনা শেষ করেছে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে। কিছুদিন আগে মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হলো। ফলাফল এখনো বেরোয়নি।আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ভেতর থেকে একটা গলা ভেসে এলো।— বাবা, চা?— হ্যাঁ, এনে দে। আমার বুক ধড়াস্ করে উঠল। এবার নিশ্চয়ই আসবে সেই মেয়ে।কিন্তু যে মেয়েটা এলো, সে একেবারেই ভিন্ন। সাদাসিধে সালোয়ার-কামিজ পরা, চুল বাঁধা নেই, মুখে কোনো সাজ নেই। কপালে পরা ছোট্ট একটা টিপ। চোখভর্তি কাজল। হাতে একটা ট্রেতে চায়ের কাপ।কাপ রেখে সে বলল, আমি রোদেলা।আমি তাকিয়ে রইলাম। এভাবে? বিয়ের কনে এভাবে নিজের পরিচয় দিতে পারে? কোনো জড়তা নেই, কোনো সংকোচ নেই! রোদেলা হাসলো। বললো, আপনি অবাক হয়েছেন দেখছি। আমরা এসব পুরোনো নিয়ম মানি না। আমার বাবা বলেছেন আপনি শিল্পী, তাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।— কিন্তু!— কিন্তু কী? আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন, তাই তো? তা হলে কথা তো বলতেই হবে। নইলে বুঝবেন কী করে, আমি কেমন!অরুণবাবু হাসলেন। বললেন, রোদেলা একটু অন্যরকম। ওকে আমি আর ওর মা মিলে খুব স্বাধীনভাবে বড় করেছি। আমরা চাইনি যে ও কারো সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াক। নিজের মনোভাব প্রকাশে ইতস্তত করুক। সহজ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার মতো সরল হোক, তারই চেষ্টা করেছি।আমার হঠাৎ করুণা দিদির কথা মনে পড়লো। তিনি ঠিকই বলেছিলেন। এই মেয়ে আলাদা। রোদেলা বসলো আমার সামনে। বললো, আমি জানি না আপনার ভাই আমাকে পছন্দ করবেন কি না। কিন্তু আমি চাই আপনি আমাকে চিনুন। আমি কে, আমি কী চাই, তা জানুন।— পাত্রের মধ্যে আপনি কী গুণ চান?রোদেলা একটু থামলো। তারপর বললো, আমি চাই এমন একজনকে যে আমাকে মানুষ হিসেবে দেখবে। যে আমার স্বপ্ন দেখবে, আমার ভয় দেখবে। যে বুঝবে যে আমি শুধু একজন স্ত্রী নই, আমি একজন স্বাধীন মানুষ।আমি চুপ করে রইলাম।রোদেলা বলল, আমি জানি এসব কথা বললে অনেকে ভ্রূ কুঁচকে ফেলে। ভাবে মেয়েটা খুব আধুনিক, খুব বেপরোয়া। সংস্কারী নয়। কিন্তু আমি তো কোনো অর্থ বিত্ত ভোগবিলাস চাইছি না, শুধু মানুষ হতে চাইছি। — আপনি ছবি আঁকেন?— হ্যাঁ। জলরং। বেশিরভাগ ল্যান্ডস্কেপ। কখনো মানুষের মুখ।— দেখাবেন? রোদেলা উঠে গেলো। একটু পরে ফিরে এলো একটা খাতা নিয়ে। খাতাটা আমার হাতে দিলো।আমি পাতা ওল্টাতে লাগলাম। একটা নদী, একটা পুরোনো মন্দির, একটা গাছের নিচে বসে থাকা বিষণ্ন তরুণী। কাঁধে ব্যাগ। ছবিটার নিচে ছোট্ট ক্যালিগ্রাফিক ডিজাইনে লেখা একটা কবিতার উদ্ধৃতি।— এই কবিতাটি কার লেখা জানেন?— না জানলে লিখবো কেন? আবুল হাসানের ‘মিসট্রেস: ফ্রি স্কুল স্ট্রিট’ কবিতা। আমার ভীষণ প্রিয় কবিতা। এ ছবিটায় কবিতাটির দৃশ্যরূপ দিয়েছি। জানালার গ্রিল গলে বিকেলের উত্তাপহীন কমলা রঙের রোদ রোদেলার চোখেমুখে লেপ্টে আছে আদুরে বিড়ালের মতন। চোখের কাজল, কপালের ছোট্ট টিপখানা আর ওর চাউনি—সব মিলিয়ে রোদেলার তারুণ্যের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের ওপর পড়েছে একটা প্রখর দীপ্তি। বাঁ কপালে একটা সেলাইয়ের দাগ কোমল মুখে এনে দিয়েছে একটা বিশেষত্ব, একটা তীব্র ব্যক্তিত্বের ছাপ। রোদেলার প্রতিটা ছবিতে এমন একটা নিঃসঙ্গতা, এমন একটা নীরবতা যে আমার মনে হল এই মেয়ে অনেক কিছু দেখেছে জীবনে।— ছবিটা যেন জীবন্ত। ভীষণ সুন্দর! — ধন্যবাদ।— শাওন খুব চুপচাপ। বই নিয়ে, গবেষণা নিয়ে, চিন্তা নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। তবে মানুষ হিসেবে নিরেট৷ আপনার ভালো লাগবে। রোদেলার স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর, আমিও চুপচাপ। মানে, আমি অনেক কথা বলি না। কিন্তু যখন বলি, তখন মন দিয়ে বলি।অরুণবাবু বললেন, রোদেলার মা আমাদের সঙ্গে নেই। ক্যানসারে মারা গেছেন তিন বছর আগে। রোদেলাকে একা সামলাচ্ছি আমি।আমার গলা শুকিয়ে এলো। বললাম, দুঃখিত!— দুঃখিত কেন? মৃত্যু তো জীবনেরই একটা অংশ। আমরা শিখেছি তাকে মেনে নিতে।রোদেলা বললো, মা চলে যাওয়ার পর আমার ছবিগুলো বদলে গেছে। আগে আমি রঙিন ছবি আঁকতাম। এখন আঁকি শুধু কালো-সাদা। মাঝে মাঝে একটু কমলা রং দিই।— কেন কমলা?— কারণ কমলা রং মৃত্যুর রং নয়। কমলা রং সূর্যাস্তের রং। শেষ হওয়ার রং। কিন্তু শেষ হওয়ার পরেও একটা আশা থাকে যে আবার সূর্যোদয় হবে। আমি তাকিয়ে রইলাম এই মেয়েটার দিকে। অনিন্দ্য অসাধারণ এক সত্তা, যেন একটা জ্বলন্ত মশাল।একটু পর রোদেলা ঘরের মধ্যে চলে গেলো।অরুণবাবু বললেন, পাত্রের জীবনবৃন্তান্ত আর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য আমার পছন্দ হয়েছে। আমাদের তো দেখে গেলেন। জানাবেন সিদ্ধান্ত। কিন্তু...— কিন্তু কী?— কিছু কথা আছে, রোদেলার সম্পর্কে। যা আপনাকে না বললে অন্যায় হবে। — বলুন। প্রফেসর অরুণ সাহেব ইতঃস্তত করছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, এমন কোনো বিষয় যা হয়তো অন্য কোনো পরিবার হলে নির্দ্বিধায় গোপন করে যেতো। আপাদমস্তক সৎ ও দ্বিধাহীন মানুষ বলেই হয়তো বলতে চাচ্ছেন।— আমার মেয়েটির একটি বেদনাবহ অতীত আছে। — কীরকম? প্রফেসর অরুণ সাহেব সংক্ষেপে যা জানালেন, তার মর্মার্থ এরকম—রোদেলার মা মারা যাবার পর রোদেলা ভঙ্গুর ও বিষণ্ন মানসিক অবস্থায় ওরই সহপাঠী জুনায়েদ নামের এক বন্ধুর সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে জুনায়েদের ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক রূপ বের হতে থাকে। মানসিক শোষণ চলছে একদিকে, অন্যদিকে রোদেলাকে প্রায় গৃহবন্দি করে ফেলে। এমনকি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয় মেয়েটি। রোদেলার বাহ্যিক সৌন্দর্যে কমতি আছে, রোদেলা সংস্কারী নারী নয়—ম্যানুপুলেটিং কথাবার্তা বলে ছেলেটি ওর সাথে সম্পর্কের ইতি টেনে ওই দিনই পারিবারিকভাবে বিয়ে করে। একদিকে মায়ের মৃত্যু, অন্যদিকে দীর্ঘ দু’বছরের শোষণে রোদেলার অবস্থা মৃতপ্রায় ছিল। তবে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠে রোদেলা। যতবার মাড়িয়ে ফেলবে, ততবার ঘাস হয়ে ফুটবে। আমি অরুণবাবুর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। মেয়ের জীবনের এই ঘটনাটুকু তিনি বরপক্ষকে না জানালেও পারতেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, তার সহজ সত্য অকপট অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণের জায়গা থেকে। তিনি হয়তো ইঙ্গিতটি দিয়ে চেয়েছিলেন, রোদেলার সাথে পরবর্তীতে সামান্যতম অন্যায় হলেও তিনি সমাজের তোয়াক্কা না করে পরম মমতায় মেয়েকে গ্রহণ করবেন।আমি বললাম, আমাকে একটু সময় দিন। গিয়ে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবো। পথে বেরিয়ে এলাম। অনেকখানি হেঁটে যেতে হবে বাসস্ট্যান্ডে। রিকশা নিলাম না। মনের জ্বলুনিটা হাঁটায় কমুক। ফেরার পথে বাসে বসে ভাবছিলাম। রোদেলাকে দেখলাম। তার সঙ্গে কথা বললাম। কিন্তু কী বলব শাওনকে?করুণা দিদি জিজ্ঞেস করবেন, কেমন লাগল? আমি কী বলব? বলব যে মেয়েটা অসাধারণ? বলব যে ওর মধ্যে একটা আগুন আছে? বলব যে, ও খুব সাহসী, খুব স্পষ্ট?কিন্তু শাওন কী চায়? শাওন কি এমন একটা মেয়েকে সামলাতে পারবে? শাওন তো খুবই সাধারণ জীবনযাপন করে। বই, ক্লাস, গবেষণা। রোদেলা তো ঝড়ের মতো।বাড়ি ফিরে দেখি করুণা দিদি আমার ঘরে বসে আছেন। শাওনও আছে।— বল, কেমন হলো কনে দেখা?— দিদি, মেয়েটা অন্যরকম।— অন্যরকম মানে?— মেয়েটা খুব স্বাধীনচেতা। ও জানে ও কী চায়। ও কারো সামনে মাথা নিচু করে বসবে না।শাওন চুপ করে শুনছিল। এবার বললো, তুমি কী মনে করো?আমি তাকালাম ওর দিকে। বললাম, আমি মনে করি তুমি ওর সঙ্গে একবার দেখা করো। ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। তোমাকেও কথা বলতে হবে।করুণা দিদি বললেন, তুই কী বলছিস শাওন? রাজী?শাওন বলল, দিদি, আমি একটা কথা বলি। আমি বিয়ে করতে চাই এমন একজনকে যে আমাকে বদলে দেবে। যে আমার জীবনে ঝড় তুলবে। আমি আর একা থাকতে চাই না নিজের বইয়ের জগতে।আমি হাসলাম। বললাম, তা হলে রোদেলাই ঠিক আছে তোমার জন্যে। দুই মাস পরে শাওন আর রোদেলার বিয়ে হলো। ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান। রোদেলা সাদা শাড়ি পরেছিল, কপালে সিঁদুর দেওয়ার বদলে একটা কমলা রঙের টিপ দিয়েছিল।বিয়ের পর একদিন রোদেলা আমাকে ডেকে বলল, আপনাকে একটা কথা বলি?— বলো।শাওনের বিয়ের পর রোদেলার প্রতি আমার সম্বোধন স্নেহের সম্পর্কে ‘তুমি’তে পৌঁছেছে।— আপনি সেদিন আমার দিকে তাকিয়েছিলেন এমনভাবে যেন আমি একটা মানুষ। একটা পণ্য নয়। সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।আমি বললাম, আমি তো কিছুই করিনি।— না, করেছেন। রোদেলা বলল। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার ছবি দেখেছেন। আমাকে চিনতে চেয়েছেন। এটাই অনেক। আমি বহু সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আপনি আমাকে দেখতে না এসে অন্য কেউ এলে হয়তো এখানেও কিছু হতো না। আমি অনুভব করেছিলাম, আমাকে কেউ পরখ করতে আসেনি।আমি চুপ করে রইলাম।রোদেলা বললো, আপনি জানেন, আমার মা মারা যাওয়ার পর কিছু ঘটনায় আমি ভেবেছিলাম আমি কখনো বিয়ে করবো না। ভেবেছিলাম বিয়ে মানেই হলো কারো অধীন হওয়া। কিন্তু শাওন আলাদা। উনি আমাকে স্বাধীন থাকতে দেন। আমাকে স্বপ্ন দেখান, স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেন।আমি বললাম, তুমি সুখী তো?— হ্যাঁ। রোদেলা বলল। আমি সুখী। বিয়ের এক বছর পর রোদেলা একটা আর্ট গ্যালারিতে ওর প্রথম প্রদর্শনী করলো। শাওন আমাকে নিয়ে গেল। প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘কমলা রঙের রোদ’। প্রতিটা ছবিতে ছিল সেই একই রং—কমলা। কিন্তু প্রতিটা ছবি আলাদা। একটা ছবিতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, তার চারপাশে কমলা আলো। আরেকটা ছবিতে একটা পুরোনো বাড়ি, জানলা দিয়ে ঢুকছে কমলা রোদ।আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন এই নাম?রোদেলা বলল, কারণ সেদিন যখন আপনি আমাকে দেখতে এসেছিলেন, তখন জানলা দিয়ে এমনই একটা রোদ এসেছিলো।কমলা রঙের। আমার মনে হয়েছিল এই রোদ একটা সংকেত দিচ্ছে। বলছে যে জীবনে এখনো আলো আছে।আমি বললাম, তুমি ঠিক বলেছো।শাওন পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, রোদেলা আমাকে বদলে দিয়েছে। ও আমাকে শিখিয়েছে যে জীবন শুধু বইয়ের পাতায় নেই, জীবন আছে চারপাশে। আমি দুজনকে দেখলাম। তাদের চোখে একটা শান্তি, একটা তৃপ্তি।করুণা দিদি এসেছিলেন সেদিন। প্রদর্শনী দেখে আমাকে বললেন, তুই ঠিক করেছিলি। রোদেলাই ছিল ঠিক মেয়ে।আমি বললাম, আমি তো শুধু গিয়েছিলাম দেখতে।— না, করুণা দিদি বললেন। তুই গিয়েছিলিস বুঝতে। এবং তুই বুঝিয়েছিলিস আমাদের।সন্ধ্যা নামছিল তখন। গ্যালারির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো বাইরের আকাশ। সূর্য ডুবছিলো। সমস্ত আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছিলো একটা কমলা আভায়।রোদেলা দাঁড়িয়ে ছিল জানলার কাছে। সে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। শাওন তার পাশে। দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই কমলা রঙের রোদ।আমার মনে হলো, এই দৃশ্যটাও একটা ছবি। একটা জীবন্ত ছবি। যেখানে দুটো মানুষ খুঁজে পেয়েছে একে অপরকে। যেখানে একটা মেয়ে আর পণ্য নয়, সে একজন মানুষ। যেখানে একটা ছেলে আর বইয়ের পাতায় হারিয়ে নেই, সে বেঁচে আছে বাস্তব জগতে। নারী আর নারীর জীবনের রাজনীতি। তারা ভালোবাসে পুরো হৃদয় দিয়ে, কিন্তু পায় টুকরো। তারা বিনিয়োগ করে নিজেদের শ্রম, অর্থ, সময়, স্বপ্ন—কিন্তু সেসবের প্রাপ্তি অধিকাংশ সময়েই অবজ্ঞা। পুরুষতন্ত্র সমাজ খুব ভালো ভাবেই নারীদের প্রতি এসব আচরণকে স্বাভাবিকীকরণ করে ফেলেছে। সমাজ নারীদের শেখায় ত্যাগ করতে, সেবা করতে। পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্র নারীকে পণ্য বানায়—রূপের পণ্য, যৌতুকের পণ্য, সেবার পণ্য। আর রোদেলা নিজেকে কখনো পণ্য মনে করেনি। দ্বান্দ্বিকতার সূচনা এখানেই। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলে, প্রতিটা শেষই একটা নতুন শুরু। প্রতিটা পরাজয় লুকিয়ে রাখে নতুন সংগ্রামের বীজ। রোদেলা সাময়িকভাবে নিজের আত্মবিশ্বাস ও নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসা হারিয়েছিলো, এটা সত্য। কিন্তু এই হার তাকে শিখিয়েছে—ভালোবাসা আদতে রাজনীতির খেলা, সম্পর্ক ক্ষমতার খেলা। নারী হিসেবে তারা সব সময় হেরে যায় এই খেলায়, কারণ নিয়মগুলো তৈরি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু হার মেনে নেওয়া আর হেরে যাওয়া এক নয়। রোদেলা ঠকেছে জুনায়েদের কাছে, কিন্তু হার মানেনি জীবনের কাছে। আমি বেরিয়ে এলাম গ্যালারি থেকে।রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, সন্ধ্যার আলো নিভে যাচ্ছে। রাত নামছে।কিন্তু আমি জানি, আবার একদিন সূর্য উঠবে। আবার আসবে সেই কমলা রঙের রোদ। যে রোদ বলে দেয় যে জীবনে সব সময় আশা আছে। সব সময় নতুন করে শুরু করার সুযোগ আছে।রোদেলা সেই রৌদ্রোজ্জ্বল আলোকিত মেয়ে। সে তার নিজের আলো নিজেই জ্বালিয়ে রেখেছে। লেখকের আরও গল্পফারজানা অনন্যার গল্প: নিঃশেষে বিভাজ্য ফারজানা অনন্যার গল্প: নরকের গান এসইউ