এক সময় অগ্রহায়ণ মাস এলেই উত্তরের জনপদগুলোতে নেমে আসত হাড়কাঁপানো শীত ও ঘন কুয়াশা। বিশেষ করে এই অঞ্চলে নভেম্বরের শুরু থেকেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই চিরচেনা শীতের রূপ বদলে গেছে। ডিসেম্বরের শেষ প্রান্তে এসেও রংপুরে মিলছে না অতীতের মতো তীব্র শীত; শীতের আমেজ থাকলেও আশঙ্কাজনক হারে কমছে এর প্রকোপ ও স্থায়িত্ব। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে রংপুর অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনে রোদের কারণে বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে, আর রাতে কিছুটা শীত থাকলেও তা খুব বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। ফলে আগের মতো টানা শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়তে হচ্ছে না এই জনপদকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি, স্থানীয়ভাবে গাছপালা কমে যাওয়া এবং শিল্পায়নের প্রভাবও এর জন্য দায়ী। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য শীতের প্রকোপ কমে যাওয়া কিছুটা স্বস্তির হলেও ঋতু পরিবর্তনের এই অস্বাভাবিকতা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে কৃষিতেও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রংপুরের স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মফিজুর রহমান বলেন, আগে নভেম্বর মাস থেকেই আমরা লেপ-কাঁথা বের করতাম, কিন্তু এখন ডিসেম্বর শেষ হতে চলছে অথচ আগের সেই কনকনে ঠাণ্ডা নেই। প্রকৃতির এই বদল আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। নগরীর সুরভী উদ্যানের সামনে মৌসুমী শীতের কাপড় বিক্রেতা আব্দুল মান্নান জানান, ২০ বছর ধরে তিনি শীতের এই সময়টা গরম কাপড় বিক্রি করেন। আগে যে হারে কাপড় বিক্রি হতো এখন তার অর্ধেক বিক্রি হয় না। শীতের প্রকোপ ও স্থায়িত্ব কম থাকলে ব্যবসাও ভালো হয় না। শহরের হাড়িপট্টি রোডের জননী বস্ত্রালয়ে দশ বছর ধরে চাকরি করছেন সোহাগ মিয়া। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ৭ থেকে ৮ বছর আগেও যে পরিমাণ লেপ ও তোশক বিক্রি হতো, এখন তার অর্ধেকও হয় না। শীত আসলেও তা দেরিতে আসছে এবং বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। রংপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, শীত কমে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ জড়িত। এর মধ্যে প্রথমত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এরপর হিমেল বাতাসের অভাব। দিন এবং রাতের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্যটা যদি কমে যায়, তবে শীতের অনুভূতি তেমন থাকে না। আবার এই সময়টাতে যদি সূর্যের উপস্থিতি বেশি থাকে, তবে দিনে তাপমাত্রা খুব একটা কমে না, ফলে শীত অনুভূত হয় না। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে বলতে গেলে, শীতকালের ‘শিফট’ হচ্ছে। অর্থাৎ আগে যে বৈশিষ্ট্য ছিলো- অক্টোবরের শেষের দিক থেকে নভেম্বরের শুরুতেই শীত নামার কথা, ডিসেম্বর মাসে যে পরিমাণ শীত থাকার কথা, সে পরিমাণ এখন নেই। আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতের যে স্বাভাবিক সময় ও তীব্রতা, তা এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। এর নেতিবাচক প্রভাব মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখি- সবার ওপরই পড়ছে। স্বাভাবিক জীবনচক্র বিঘ্নিত হওয়ায় নানা রোগব্যাধির আক্রমণ দেখা দিচ্ছে। ফসলের উৎপাদনও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সব মিলিয়ে এটি আমাদের জন্য একটি বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির উৎস কমে যাওয়া, বাতাসে ধূলিকণাসহ বিভিন্ন কণাযুক্ত হওয়া, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হওয়া,যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে শীতের প্রকোপ ও স্থায়িত্ব কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণত বছরের এই সময়টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি থাকার কথা, কিন্তু সেখানে সকাল ৯টার দিকে ১২ থেকে ১৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। আর দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২১ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত তাপমাত্রা কমে আসলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ডিসেম্বর মাসে রংপুরে গড়ে ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। এছাড়া বছরজুড়ে যে পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেটাও হয়নি। কেবল জুলাই মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া অন্য মাসগুলোতে গড়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। বছরে রংপুরে ২৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও এ বছর বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৭০০ থেকে ১৮০০ মিলিমিটার। পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়াটাও শীতের প্রকোপ ও স্থায়িত্ব কমার একটা কারণ। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ এবং জানুয়ারির শুরুতে একটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে মোস্তফিজার রহমান বলেন, জানুয়ারি মাস জুড়ে ২ থেকে ৩টি মাঝারি এবং ১ থেকে ২টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সময় তাপমাত্রা কোথাও ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে নেমে আসতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা স্থায়ী হতে পারে, যার ফলে সূর্যের আলো অনেক দেরিতে দেখা যেতে পারে। রংপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল লালমনিরহাটে ১৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া রংপুরে ১৩.২, ঠাকুরগাঁওয়ে ১২.৩, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও দিনাজপুরে ১২.৫, গাইবান্ধায় ১৩.৫, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১৩ এবং নীলফামারীর ডিমলায় ১৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। জিতু কবীর/এনএইচআর/এএসএম