ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী বন্দরনগরী ওডেসায় নতুন করে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এতে বন্দর স্থাপনা ও একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওডেসা অঞ্চলের গভর্নর।গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) গভীর রাতে চালানো এই হামলার কয়েকদিন আগে ওডেসা ও আশপাশের এলাকায় একটানা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় রুশ বাহিনী। এই অঞ্চলেই রয়েছে ইউক্রেনের বৈদেশিক বাণিজ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বন্দর। এর আগেই ইউক্রেনকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল রাশিয়া। ওডেসা ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় বন্দরনগরী। সেখানে হামলা বাড়ার এই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার ফ্লোরিডায় মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা। পরদিন শনিবার রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন মার্কিন দূত। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কিয়েভে সাংবাদিকদের বলেন, “ওডেসা অঞ্চলের পরিস্থিতি ভয়াবহ। বন্দর অবকাঠামো ও সরবরাহ ব্যবস্থায় হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। তারা আবারও ইউক্রেনের সমুদ্রে প্রবেশাধিকার সীমিত করতে এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলো অবরুদ্ধ করতে চাইছে।” সর্বশেষ হামলায় কী ঘটেছে? মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) ওডেসা আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের প্রধান ওলেহ কিপার জানান, রাতের হামলায় একটি বেসামরিক পণ্যবাহী জাহাজ ও একটি গুদাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি, দুইতলা একটি আবাসিক ভবনের ছাদে আগুন ধরে যায়। এর আগে গত শনিবার (২০ ডিসেম্বর) ওডেসার কাছের পিভদেন্নি বন্দরে হামলায় জ্বালানি সংরক্ষণাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ওলেক্সি কুলেবা। তার একদিন আগে (১৯ ডিসেম্বর) একই এলাকায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৮ জন নিহত এবং অন্তত ৩০ জন আহত হন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই অঞ্চলজুড়ে সংঘর্ষের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। গত সপ্তাহে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে যুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে বড় বিমান হামলাগুলোর একটি চালায় রাশিয়া। এতে বিদ্যুৎ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ওডেসায় কয়েক দিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে, ভোগান্তিতে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ। আরও পড়ুন: রাশিয়াকে ‘যৌক্তিক জবাব’ দেয়ার হুঁশিয়ারি জেলেনস্কির রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এসব হামলা নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ক্রেমলিন আগেই জানিয়েছে, ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে তারা ‘বৈধ সামরিক লক্ষ্য’ হিসেবে বিবেচনা করে। টেলিগ্রামে কুলেবা জানান, রুশ বাহিনী ডিনিস্টার নদীর ওপর মায়াকী গ্রামের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুতে হামলা চালিয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় পাঁচবার হামলার পর সেতুটি বর্তমানে অচল। এই পথ দিয়েই সাধারণত ইউক্রেনের প্রায় ৪০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ আসে। কেন ওডেসাকে লক্ষ্য করছে রাশিয়া? উপপ্রধানমন্ত্রী কুলেবার মতে, যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু এখন ওডেসার দিকে সরে আসছে। রাশিয়া ইউক্রেনের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে এই ‘উন্মত্ত’ হামলা আরও জোরদার করতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন। এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরীয় প্রবেশাধিকার সীমিত করাই এখন মস্কোর লক্ষ্য। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার তেলবাহী জাহাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের এ পদক্ষেপ। ইউক্রেনের জন্য ওডেসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ওডেসা দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেনের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। ‘সমুদ্রের মুক্তা’ নামে পরিচিত এই শহরটি কিয়েভ ও খারকিভের পর ইউক্রেনের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। যুদ্ধের আগে ওডেসা, পিভদেন্নি, চর্নোমর্স্ক ও মিকোলাইভ—এই কৃষ্ণসাগরীয় বন্দরগুলো দিয়েই ইউক্রেনের ৭০ শতাংশের বেশি রপ্তানি হতো। রাশিয়া জাপোরিঝিয়া, খেরসন ও মিকোলাইভ অঞ্চলের বন্দর দখল করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওডেসার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পরও ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ গম ও ভুট্টা রপ্তানিকারকের মধ্যে রয়েছে। এর বড় অংশই যায় ওডেসা বন্দর দিয়ে। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের মতে, বন্দর লক্ষ্য করে হামলার মাধ্যমে পুতিন ইউক্রেনের বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক অবকাঠামো ধ্বংস করতে চাইছেন। ওডেসা ধ্বংস হলে কী প্রভাব পড়বে? ওডেসা বন্দর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইউক্রেনের অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধাক্কা লাগবে। শিপিং ও লজিস্টিক খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হারাবে মানুষ, কমে যাবে আয়। জাতীয় পর্যায়ে রপ্তানি সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শস্য ও অন্যান্য পণ্যের রফতানি ব্যাহত হলে পরিবহন খরচ বাড়বে, রফতানি কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে চাপ পড়বে। এতে ইউক্রেনের মুদ্রা হৃভনিয়া দুর্বল হতে পারে। একই সঙ্গে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন, বাড়বে সংরক্ষণ সংকট। সরকার হারাবে শুল্ক আয়, আর পুনর্গঠন ব্যয় বাড়বে—যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করবে। কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধের নতুন মাত্রা গত ছয় মাসে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সামুদ্রিক সংঘর্ষ তীব্র হয়েছে। দুই পক্ষই নৌ ও বাণিজ্যিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে। ইউক্রেন পানির নিচের ড্রোন ও মানববিহীন নৌযান ব্যবহার করে রাশিয়ার শ্যাডো ফ্লিটের জাহাজে হামলা বাড়িয়েছে। নভেম্বরে তুরস্কের জলসীমার কাছাকাছি কৃষ্ণসাগরে কাইরোস ও ভিরাত নামের কয়েকটি তেলবাহী জাহাজে হামলার দাবি করে কিয়েভ। ডিসেম্বর ১৯ তারিখে ভূমধ্যসাগরে রাশিয়াসংশ্লিষ্ট কেনডিল ট্যাংকারে ড্রোন হামলার দাবিও করে ইউক্রেন—যা তাদের সামুদ্রিক অভিযানের পরিসর বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। আরও পড়ুন: তেল মজুতাগারে ফের হামলা রাশিয়ার, প্রাণপণ লড়ছে ইউক্রেন একই সময়ে রাশিয়াও বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা জোরদার করেছে। ১৩ ডিসেম্বর ওডেসার কাছে তুরস্কের পতাকাবাহী একটি পণ্যবাহী জাহাজে ড্রোন হামলা চালানো হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঘটনা প্রমাণ করে যুদ্ধ এখন ‘অ্যাসিমেট্রিক নৌযুদ্ধের’ দিকে যাচ্ছে, যেখানে ড্রোন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা ব্যবস্থায় আঘাত হানা হচ্ছে।