পিরোজপুরে-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী না দেওয়ায় তৃণমূলে অসন্তোষ

মনোনয়ন দাখিলের দিন ঘনিয়ে এলেও এখনো পিরোজপুর-১ আসনে বিএনপির চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা না করায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, জোটের প্রার্থী নয় বরং দলের ত্যাগী ও দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের মূল্যায়ন করে মনোনয়ন দিলে দল আরও বেশি সুসংগঠিত হবে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্য থেকেই প্রার্থী চূড়ান্ত করার দাবি পিরোজপুর-১ আসনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের। তবে দেশের স্বার্থে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে সে সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে তার পক্ষে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন নেতারা। পিরোজপুর জেলার তিনটি সংসদীয় আসনের ভেতরে অন্যতম পিরোজপুর-১ আসন। পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরানী নিয়ে গঠিত হয়েছে আসনটি। বেশ কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে বিএনপি শরিকদের ছেড়ে দেওয়ায় এ আসনের নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নেতিবাচক চিন্তা যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপরে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুঞ্জন রয়েছে এবারও শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হতে পারে এই আসনটি। এ কারণে পিরোজপুর জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্যাতনের শিকার হওয়া বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা দাবি করছেন, তাদের মধ্য থেকেই যোগ্য প্রার্থীকে এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হোক। অন্যথায় দলের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং নেতাকর্মীদের আগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নেতাকর্মীদের বলছেন, বারবার জোটের প্রার্থী নির্ভর রাজনীতির ফলে পিরোজপুরে বিএনপির নিজস্ব অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঠপর্যায়ে যারা মামলা, হামলা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন না হলে দলকে সুসংগঠিত রাখা কঠিন হবে। এ কারণে পিরোজপুরের তৃণমূল বিএনপি এবার নিজেদের মধ্য থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশা করছে। পিরোজপুর জেলায় সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করে। সে সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরাসরি অংশ নেয়নি। ফলে পিরোজপুরে বিএনপির নিজস্ব প্রার্থী না থাকলেও জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো বর্জন করায় পিরোজপুরসহ দেশের বহু আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সুধাংশু শেখর হালদারকে পরাজিত করে ব্যক্তি ইমেজের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে একই আসনে জয় পান তিনি। ২০০৮ ও ২০১৮ সালেও মনোনয়ন পান মাওলানা সাইদী এবং তার ছেলে শামীম সাইদী। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি আলাদা নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ায় পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন প্রয়াত জামাত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর ছেলে ও ইন্দুরকানী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ সাইদী। অন্যদিকে এই আসনে বিএনপি ও শরিক জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অন্তত সাতজন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ আলমগীর হোসেন, পিরোজপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম খান, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও সাংবাদিক হাফিজ আল আসাদ সাঈদ খান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এলিজা জামান, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাইদুল ইসলাম কিসমত, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন খান এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। এছাড়াও আরও কয়েকজন নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠপর্যায়ে আলোচনায় রয়েছেন। পিরোজপুর-১ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬৬ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯১ হাজার ৪৯৭ জন। এখানে মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১৬৭ টি। সব মিলিয়ে পিরোজপুরে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে বিএনপির ভেতরে-বাইরে রাজনৈতিক সমীকরণ দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা আশা করছেন, দলীয় নেতৃত্ব এবার তাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাবে এবং পিরোজপুরে বিএনপির নিজস্ব শক্তি ও পরিচয় পুনরুদ্ধারে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে। পিরোজপুর-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে হাহাকার, তারা ভোট দেবে ধানের শীষে ঠিক আছে। কিন্তু কাকে দেবে, কার পিছনে তারা মিছিল করবে, কার পিছনে তারা হাঁটবে সেই মানুষটিকে তারা এখনো খুঁজে পাচ্ছে না। যে নাম শোনা যায় সে কী ১৭ বছরে একদিনও এসেছে? তারা কি আমাদের নেতাকে চেনেন, আমাদের কর্মীদের চেনেন? যে কর্মী জেল খেটেছে, নিজের পয়সায় মামলা চালিয়েছে তাকে কী এই নেতা চেনেন? কিন্তু তাদের আমরা চিনি। ভালোবাসার মাধ্যমে অর্জন করেছি। দলকে ভালবাসে তাই বিগত বছরগুলোতে তারা আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। ১৭ বছরের লড়াকু যোদ্ধারা আজ কাদছে। তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নমিনেশনের কোনো মিল নেই। তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কেন্দ্রের মিল আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের নেতাকর্মীরা এখনো বিশ্বাস করে আমাদের নেতা তারেক রহমান আমাদের মধ্য থেকে কেউকে নমিনেশন দেবেন। মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাইদুল ইসলাম কিসমত বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোতে জোটের প্রার্থীরা বিএনপি নেতাকর্মীদের ভোট নিয়ে সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তারপরে তারা দলের কাজ করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের ভোট নিয়ে, সমর্থন নিয়ে তারা নির্বাচিত হয়েছেন এবং তার দলের পক্ষে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের বৃহৎ স্বার্থে আমরা এই ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করেছি। তবে এটা ধারাবাহিকভাবে হতে গেলে সমস্যা হয়। নেতাকর্মীরা হতাশ হয়। নেতাকর্মীরা কাজ করার প্রাণ পায় না। পিরোজপুর-১ আসনে এখনো নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ। তারা চায় বিগত দিনে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলো এমন একজন প্রার্থী। আমরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবো। সব মিলিয়ে পিরোজপুর-১ আসনে বিএনপি থেকে একজনকে মনোনয়ন দিলে জামায়াত এবং বিএনপির মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। মো. তরিকুল ইসলাম/এনএইচআর/এমএস