বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘ দমন–পীড়ন, মামলা, গ্রেপ্তার ও ভয়ভীতির মধ্যেও বিএনপি যে ভেঙে পড়েনি, তার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসে তৃণমূলের সঙ্গে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিবিড় যোগাযোগ। বিদেশে অবস্থান করেও তিনি যেভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ বজায় রেখেছেন, তা শুধু দলের ভেতরেই নয়— রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও আলোচিত বিষয়।২০০১ থেকে ২০০৬ সালকে তারেক রহমানের তৃণমূলভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তিকাল হিসেবে ধরা হয়। সে সময় তিনি দেশের ৬৪টি জেলাকে ২০টি সেক্টরে ভাগ করে একের পর এক কনফারেন্স আয়োজন করেন। এসব কনফারেন্সে শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং কৃষক, জেলে, দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষের কথা সরাসরি শোনার ওপর জোর দেন তিনি। সমস্যার ধরন অনুযায়ী প্রতিটি অঞ্চলভিত্তিক আলাদা সুপারিশমালা তৈরি করা হয়। ওই সময় প্রায় ৮০টি সুপারিশমালা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তুলে দেন তারেক রহমান। উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজ হাতে দেশের খাল–নদী–নালার মানচিত্র তৈরির উদ্যোগও ছিল তার।এই প্রক্রিয়ার বাইরে নিয়মিত রোড মিটিং, স্থানীয় বৈঠক ও অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে তৃণমূল রাজনীতিকে তিনি নতুন করে সক্রিয় করেন। বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোতে আনুষ্ঠানিক পদে না থেকেও সাংগঠনিক কার্যক্রমে তার প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। তৃণমূলের রাজনৈতিক চর্চাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোই ছিল তার মূল লক্ষ্য।যশোর সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আঞ্জারুল হক খোকন মনে করেন, এই ধারাবাহিক সংযোগই বিএনপিকে সবচেয়ে কঠিন সময়েও ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। তার ভাষায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা ও যোগাযোগ এতটাই কার্যকর ছিল যে নেতাকর্মীরা কখনো তাকে দূরে মনে করেননি। ভার্চুয়াল বৈঠকগুলো বাস্তব উপস্থিতির মতোই অনুভূত হতো। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই সংযোগ নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়িয়েছে এবং সংগঠনকে সচল রেখেছে।তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে তারেক রহমানের সরাসরি উপস্থিতি দলীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। ভার্চুয়াল যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সরাসরি নেতৃত্বের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিভেদ দূর হবে, সংগঠন আরও সুসংহত হবে এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আরও পড়ুন: নিরপরাধ হয়েই দেশে ফিরছেন তারেক রহমান, নেপথ্যে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামতৃণমূল পর্যায়ের এমন সংযোগ যে শুধু জেলা বা উপজেলা পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার প্রতিফলন দেখা যায় ছাত্ররাজনীতিতেও। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক আহম্মেদ অর্ক স্কুল জীবন থেকেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয়। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো দলীয় পদ পাওয়া এই তরুণ ছাত্রনেতা রাজনীতির কঠিন সময়ে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নূর হোসেনের আদলে গণতন্ত্র ও দলের চেয়ারপার্সনের মুক্তির দাবিতে বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।অর্ক জানান, এই ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতিতে তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ভার্চুয়ালি তিনি দুইবার তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন— একবার আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল সময়ে এবং দ্বিতীয়বার জুলাই–আগস্টে সফল গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্ত পরিবেশে। দ্বিতীয়বার কথা বলার সময় তিনি প্রথমে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় ও নাম জানান। তখন তারেক রহমান ভুলবশত তাকে ‘অর্ঘ’ বলে সম্বোধন করেন। বিষয়টি তৃতীয়বার বুঝতে পেরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই আবার তার নাম জানতে চান এবং পরে ‘অর্ক’ নামে ডেকে বলেন, নামটি সুন্দর এবং আগেরবারই তিনি নামটি বুঝতে পেরেছিলেন।অর্কের ভাষায়, একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! এমন সরাসরি সান্নিধ্য ও স্বীকৃতি তাকে সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চায় আরও দৃঢ় করেছে। ভবিষ্যতেও তিনি এমন নেতৃত্বের কাছাকাছি থাকতে চান বলে জানান।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, বিএনপি তার ইতিহাসের একাধিক সংকট পার করেছে। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর যেমন দল বড় চ্যালেঞ্জে পড়ে, তেমনি ২০০৬ সালের পর বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টায় বিএনপি আবারও কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়। সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার বন্দিত্ব, তারেক রহমানের গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং পরবর্তী সময়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হওয়া— সব মিলিয়ে দলের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হয়। আরও পড়ুন: নির্বাচন ঘিরে তারেক রহমানকে নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা বিএনপিরতার মতে, এই সংকটে দল পরিচালনার ভার কার্যত তারেক রহমানের কাঁধেই এসে পড়ে। পিতার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, ২০০১–২০০৬ সময়ের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা এবং বিদেশে অবস্থানকালীন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ— এই তিনের সমন্বয়েই তিনি দলকে সংগঠিত রাখতে সক্ষম হন। শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখাই ছিল তার বড় সাফল্য।ড. সিদ্দিকুর রহমান খান মনে করেন, লাখ লাখ মামলা, হাজারো নেতাকর্মীর নির্যাতন ও হত্যার পরও বিএনপিকে ভাঙার সরকারি প্রচেষ্টা সফল না হওয়ার পেছনে এই দ্বিমুখী যোগাযোগ কৌশল বড় ভূমিকা রেখেছে। তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে না দেওয়াই বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রেখেছে।তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রায় ২০০১–২০০৬ সময়কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেন তিনি। ওই সময় তরুণ নেতৃত্বকে সংগঠিত করা, ছাত্রদল ও যুবদলের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং সরাসরি কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেন। পরবর্তী প্রায় দেড় দশক বিদেশে নির্বাসিত জীবনেও সেই সংযোগের ধারাবাহিকতা তিনি বজায় রেখেছেন।দীর্ঘদিন লন্ডনে অবস্থানের পর আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন তারেক রহমান। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই প্রত্যাবর্তন বিএনপির তৃণমূল রাজনীতিতে নতুন গতি আনতে পারে। ভার্চুয়াল নেতৃত্বের দীর্ঘ অধ্যায়ের পর সরাসরি উপস্থিতি দলের ভেতরের সংযোগকে আরও দৃঢ় করবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।