দেখতে দেখতে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে ২০২৫ সাল। এই বছর অনেক আনন্দময় প্রাপ্তির মাঝেও হারানোর বেদনা আমাদের আহত করেছে। এ বছর ৭ জন কবি, লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী আমাদের বিষাদের অন্ধকারে ফেলে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষণ্ন করেছে তরুণ কবি শ্বেতা শতাব্দী এষের অকাল প্রস্থান। সেইসব উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রস্থান নিয়েই আজকের আয়োজন— সন্জীদা খাতুনবাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ও ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন মারা গেছেন। ২৫ মার্চ বিকেল ৩টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়েই তার কর্মজীবন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দীর্ঘকাল পড়িয়েছেন তিনি। দাউদ হায়দারজার্মানিতে নির্বাসিত চিরকুমার কবি, লেখক ও কলামিস্ট দাউদ হায়দার মারা গেছেন। ২৬ এপ্রিল রাতে জার্মানির বার্লিনের একটি বৃদ্ধাশ্রমে তার মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। দাউদ হায়দারের জন্ম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলায়। তিনি একাধারে কবি, লেখক ও সাংবাদিক। সত্তর দশকের শুরুর দিকে তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি তার এক কবিতাকে ‘দ্য বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় দাউদ হায়দারের কবিতা ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ প্রকাশিত হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে ১১ মার্চ তাকে আটক করে পুলিশ। ২০ মে সন্ধ্যায় জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পরদিন কলকাতাগামী একটি বিশেষ ফ্লাইটে তাকে তুলে দেওয়া হয়। ওই ফ্লাইটে আর কোনো যাত্রী ছিলেন না। তারপর ভারত সরকারও তাকে বহিষ্কার করে। নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের বিশেষ চেষ্টায় ১৯৮৭ সালে জার্মানিতে আশ্রয় নেন দাউদ হায়দার। হামিদুজ্জামান খানভাস্কর হামিদুজ্জামান খান মারা গেছেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২০ জুলাই সকালে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। হামিদুজ্জামান খান ১৯৪৬ সালের ১৬ মার্চ কিশোরগঞ্জের সহশ্রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ফর্ম, বিষয়ভিত্তিক ও নিরীক্ষাধর্মী ভাস্কর্যের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় তিনি নির্মাণ করেন ‘একাত্তর স্মরণে’। তিনি ২০০৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০২৩ সালে বাংলা একাডেমি তাকে ফেলোশিপ দেয়। দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ গাজীপুরের কড্ডায় তার ভাস্কর্য সংগ্রহ দিয়ে বড় এক ভাস্কর্য বাগান নির্মাণ করে। কর্মজীবনে তার শিল্পকর্ম বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, বুলগেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত এবং স্থাপিত হয়েছে। আরও পড়ুনবশির আহমেদ: সংগীতের এক কিংবদন্তি নাম হুমায়ূন আহমেদ: সময়ের প্রতিচ্ছবি যতীন সরকারস্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক যতীন সরকার মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। ১৩ আগস্ট বিকেল পৌনে তিনটায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যতীন সরকার ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়ার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক এ শিক্ষক সুদীর্ঘকাল ধরে মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। লেখক হিসেবে যতীন সরকার ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৫ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার, ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন। বদরুদ্দীন উমরলেখক-গবেষক, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন। ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার একটু পর রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। বদরুদ্দীন উমরের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নেতা ছিলেন। তিন খণ্ডে উমর রচিত পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (১৯৭০, ১৯৭৬, ১৯৮১) বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। ২০২৫ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। শ্বেতা শতাব্দী এষক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে মারা গেছেন তরুণ কবি শ্বেতা শতাব্দী এষ। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৩ বছর। ১২ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শ্বেতা শতাব্দী এষের জন্ম ১৯৯২ সালে জামালপুরে। জন্ম থেকেই কঠিন রোগ বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত ছিলেন। এর সঙ্গে লড়াই করেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। অসুস্থতা সত্ত্বেও লিখেছেন একের পর এক কাব্যগ্রন্থ। ‘অনুসূর্যের গান’, ‘রোদের পথে ফেরা’, ‘ফিরে যাচ্ছে ফুল’, ‘আলাহিয়ার আয়না’ ও ‘বিপরীত দুরবিনে’ তার কাব্যগ্রন্থ। ২০২৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘হাওয়া ও হেমন্ত’। রকিব হাসানজনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা, লেখক ও অনুবাদক রকিব হাসান মারা গেছেন। ১৫ অক্টোবর বিকেলে ডায়ালাইসিস চলাকালীন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রকিব হাসানের জন্ম ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। পড়াশোনা শেষে লেখালেখির প্রতি ঝোঁক জন্মে। তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে। স্বনামে প্রথম প্রকাশ অনুবাদগ্রন্থ ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ দিয়ে। কিশোরদের জন্য বই লিখে, অনুবাদ করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। থ্রিলার এবং গোয়েন্দা গল্প লেখার আগে তিনি অন্যান্য কাজেও যুক্ত ছিলেন। রহস্যপত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কেবল তিন গোয়েন্দারই ১৬০টি বই লিখেছেন। এ ছাড়া ৩০টি বই অনুবাদ করেছেন। এসইউ