হিজরতের সফরের প্রথম দিনেই আমাদের স্থানীয় সাথিরা আমাদের নিয়ে যান হজরত খাদিজা (রা.)-এর ঐতিহাসিক ঘর প্রদর্শনে। এই ঘরটি পবিত্র হারাম শরিফের প্রাঙ্গণের ভেতরেই, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের সন্নিকটে অবস্থিত। ইসলামের সূচনালগ্নের অগণিত স্মৃতি বহনকারী এই ঘর থেকেই নবীজি (সা.) দীর্ঘ সময় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন।এরপর আমরা এগিয়ে যাই ঐতিহাসিক দারে আরকাম–এর স্থানে। বর্তমানে এটি একটি ব্রিজের নিচে অবস্থিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে গোপনে দাওয়াত ও সাহাবিদের প্রশিক্ষণের কেন্দ্র ছিল এই দারে আরকাম। সেখান থেকে সামনে অগ্রসর হয়ে আমাদের দেখানো হয় হজরত আবু বকর (রা.)-এর ঘর। হিজরতের সময় নবীজি (সা.) হজরত খাদিজা (রা.)-এর ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমে এই ঘরেই আশ্রয় নিয়েছিলেন—ইতিহাসের সেই মুহূর্ত স্মরণ করে আমরা গভীরভাবে আপ্লুত হই। এরপর আমরা রওনা হই মিনার দিকে। এখানেই আকাবা নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিল হিজরত সংশ্লিষ্ট আনসারদের সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ঐতিহাসিক বায়াত। বর্তমানে সেখানে একটি মসজিদ নির্মিত রয়েছে। দ্বিতীয় বায়াতে আনসাররা দৃঢ় অঙ্গীকার করেছিলেন— “হে আল্লাহর রসুল, আপনি আমাদের কাছে আসুন, আমরা আপনাকে নিজেদের জান-মালের মতো রক্ষা করব।” আকাবার পাশেই আমরা দেখতে পাই জাবালে সাবীর। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, এ পাহাড়েই জিবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যখন হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর আদেশে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এখানেই জান্নাত থেকে আগত দুম্বা জবেহ করা হয়েছিল—যা কুরবানির ইতিহাসের সূচনা। এরপর আমরা পৌঁছি গারে সওর বা সওর গুহার পাদদেশে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় উপরে যাওয়ার অনুমতি না থাকলেও, নিচে দাঁড়িয়ে সেই ঐতিহাসিক স্থানটি দেখার সুযোগ হয়—যেখানে নবীজি (সা.) ও হজরত আবু বকর (রা.) তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছি ওয়াদি খলিল এলাকায়। এখানে একটি ছোট টিলার ওপর রয়েছে একটি দীর্ঘ পাথর, যাকে হাদিসে বলা হয়েছে ‘সাখরা তবিলা’। বর্ণনায় আছে—এই পাথরের নিচে ছায়া ছিল। হজরত আবু বকর (রা.) জায়গাটি পরিষ্কার করে নবীজি (সা.)-কে সেখানে বিশ্রামের অনুরোধ করেছিলেন। আমরাও সেখানে বসে খাবার গ্রহণ করি, দোয়া করি এবং সুন্নাহ পালনের নিয়তে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই। এরপর সাখরা তবিলার পুরো ঘটনা স্মরণ করে আমরা পৌঁছাই কুরাউল গামিম নামক স্থানে। এখানে একটি পাহাড় রয়েছে, যার আকৃতি মানুষের কনুইয়ের মতো—আরবি ভাষায় ‘কুরা’ অর্থ কনুই। এই স্থানেই রসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে প্রায় ৩০০ জন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন—যা ইসলামের বিস্তারে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সবশেষে আমরা রওনা হই উম্মে মাবাদ (রা.)-এর ঐতিহাসিক স্থানের দিকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সেখানেই আমরা রাত যাপন করি। হিজরতের পথে উম্মে মাবাদ (রা.)-এর ঘরে নবীজি (সা.)-এর অলৌকিক ঘটনা আজও মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। এই সফর আমাদের শুধু ইতিহাস দেখায়নি; বরং ঈমানকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে, হৃদয়ে হিজরতের ত্যাগ ও আদর্শকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।