কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে মাদকের বিস্তার এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নয়; এটি ক্রমে একটি গভীর সামাজিক, মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে ইয়াবা ও অন্যান্য সিনথেটিক মাদকের প্রবাহ শুধু ক্যাম্পের ভেতরের জীবনকেই বিপর্যস্ত করছে না, এর প্রভাব পড়ছে পার্শ্ববর্তী জনপদ, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ওপরও। এই বাস্তবতা নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যাপ্তি ও তীব্রতা যে মাত্রায় বেড়েছে, তা নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭৮ ও ১৯৯১–৯২ সালেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যে ঢল নামে, তা পূর্বের সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে যায়। মাত্র কয়েক মাসে সাত থেকে আট লাখ রোহিঙ্গার আগমন এবং পরবর্তী সময়ে মোট সংখ্যা ১২–১৩ লাখে পৌঁছানো বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট মানবিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সীমিত জায়গায়, সীমিত সম্পদের মধ্যে এবং দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তায় আটকে থাকা এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, মাদক সমস্যাকে তারই একটি ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যায়। ইয়াবা বর্তমানে ক্যাম্পে সবচেয়ে বিস্তৃত মাদক। কক্সবাজার–টেকনাফ অঞ্চল বহুদিন ধরেই ইয়াবা পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে পরিচিত। মিয়ানমারের শান ও রাখাইন অঞ্চলে উৎপাদিত এই মাদক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং প্রশাসনিক জটিলতা পাচারকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে—এ কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন—সব রোহিঙ্গা মাদক কারবারে জড়িত, এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। বরং একটি সীমিত অংশ, বিশেষ করে তরুণ ও যুবকদের একটি অংশ, এই চক্রে যুক্ত হচ্ছে। তাদের অনেকেই মূল পরিকল্পনাকারী নয়; তারা বাহক বা খুচরা পর্যায়ের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দীর্ঘদিন কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা, চলাচলের কড়াকড়ি, শিক্ষার সীমিত সুযোগ এবং মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল জীবন অনেককে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই দুর্বলতাকেই অপরাধচক্র কৌশলে কাজে লাগাচ্ছে। বাস্তবে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ থাকে ক্যাম্পের বাইরের স্থানীয় ও আঞ্চলিক সিন্ডিকেটগুলোর হাতে। সীমান্তের দুই পাশে সক্রিয় অপরাধী নেটওয়ার্ক, দালাল ও পাচারকারীরা এই ব্যবসার মূল সুবিধাভোগী। রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে তুলনামূলক কম ঝুঁকির বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কারণ তাদের আইনি সুরক্ষা দুর্বল এবং সামাজিক অবস্থান প্রান্তিক। এতে একদিকে তারা অপরাধচক্রের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে পুরো জনগোষ্ঠীটি সামাজিকভাবে কলঙ্কিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে। এই মাদক প্রবাহের প্রভাব বহুমাত্রিক। ক্যাম্পের ভেতরে মাদকাসক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুরি, সহিংসতা, দলাদলি এবং অস্ত্রের ব্যবহারও বেড়েছে। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই গভীর হচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর সম্পর্কে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ বাড়ছে। অনেক স্থানীয় মানুষ মনে করছেন, মাদক ও অপরাধের চাপ তাদের জীবনযাত্রাকেও অনিরাপদ করে তুলছে। এই সামাজিক টানাপোড়েন দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। এই সংকটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহায়তার সংকোচনের সম্পর্কও অস্বীকার করা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক তহবিল কমেছে। খাদ্য রেশন হ্রাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় কাটছাঁট ক্যাম্পবাসীর মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। যখন ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোই কঠিন হয়ে পড়ে, তখন অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকের কাছে টিকে থাকার একটি উপায় হিসেবে দেখা দেয়। এই বাস্তবতায় মাদকচক্র নতুন লোক সংগ্রহে আরও সুবিধা পায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছোবলের একটি স্পষ্ট আন্তর্জাতিক মাত্রাও রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক মাদক অর্থনীতির সঙ্গে এই সংকট ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সমস্যাটিকে কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার বিষয় হিসেবে দেখলে চলবে না; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। প্রতিকারের প্রশ্নে প্রথমেই বলা দরকার, মাদক সমস্যাকে শুধু আইনশৃঙ্খলার খাতে আটকে রাখা যাবে না। কঠোর অভিযান প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে লক্ষ্যভিত্তিক—মূল অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে। নির্বিচারে ভুক্তভোগী পর্যায়ের মানুষদের টার্গেট করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। একই সঙ্গে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা জরুরি, কারণ ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তা অপরাধের ঝুঁকি বাড়ায়। তরুণদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, খেলাধুলা ও মনোসামাজিক সহায়তা কার্যক্রম চালু করা গেলে মাদক অর্থনীতির বিকল্প তৈরি হতে পারে। শিবির ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত সংস্কারও অপরিহার্য। প্রশাসনিক সমন্বয় জোরদার, তথ্য বিনিময় কার্যকর এবং কমিউনিটি পর্যায়ে বিশ্বাসভিত্তিক নজরদারি গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের পথ সুগম করা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কল্পনা করা কঠিন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ছোবল আসলে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের উপসর্গ। এটি যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে এর অভিঘাত ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আরও বড় ঝুঁকি হয়ে উঠবে। তাই এখন প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ, তথ্যভিত্তিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নেওয়া সমন্বিত উদ্যোগ—যা একদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে একটি প্রজন্মকে অপরাধের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার বাস্তব সুযোগ দেবে। লেখকঃ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এইচআর/এএসএম