যুদ্ধবিরতিতেও দুর্দশা কাটেনি ফিলিস্তিনিদের, ইসরাইলি হামলা অব্যাহত

দুই বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় নির্বিচারে হামলার পর গত ১০ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শুরু হয়। যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় গাজার বাসিন্দারা কিছুটা আশার আলো দেখলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী হামাস জীবিত জিম্মিদের সবাইকে এবং একজন বাদে সব মৃত জিম্মি ফেরত দিলেও উপতক্যায় ইসরাইলি বর্বরতা থামেনি। বরং প্রতিদিনিই গাজার বিভিন্ন অংশে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে নেতানিয়াহু বাহিনী।২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই হামলায় ইসরাইলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত এবং ২৫০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিন থেকেই গাজায় টানা বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরাইল। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণলায় জানিয়েছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর হামলায় উপত্যকাটিতে ৭০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দেড় লাখের বেশি বাসিন্দা। এছাড়া ধ্বংস হয়ে গেছে হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্রসহ অসংখ্য বসতি। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই গাজায় যুদ্ধ থামাতে ব্যাপক কূটনীতিক তৎপরতা শুরু করেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগের দিন চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরও হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম ধাপের ৪২ দিনে ৩৮ ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছিল ইসরাইল। তবে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে হামাসের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় ইসরাইল আবারও গাজায় তীব্র হামলা শুরু করে। পরে আরব ও মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশকে সম্পৃক্ত করে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ২০ দফার একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব দেন ডনাল্ড ট্রাম্প। অক্টোবরের শুরুর দিকে মিশরে পর্দার আড়ালে চলা কয়েকদিনের নিবিড় আলোচনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন, ইসরাইল এবং হামাস তার প্রস্তাবিত ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে। এরই ধারাবাহিতকায় গত ১০ অক্টোবর গাজায় প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। শর্ত অনুযায়ী, হামাস জীবিত ২০ জিম্মিকে ফেরত দেয় এবং একজন বাদে মৃত ২৭ বন্দির মরদেহ ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করে। বিনিময়ে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে তেল আবিব। একইসঙ্গে গাজায় নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সেনাদের পিছিয়ে এনেছে ইসরাইল। গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল উপত্যকাটিতে হামলা বন্ধ করবে ইসরাইল। এছাড়া সেনা প্রত্যাহার, ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়ার সঙ্গে বন্দি বিনিময় করতে বলা হয়েছিল। আরও পড়ুন: গাজা থেকে সেনাবাহিনী কখনই পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে না: ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী তবে যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন থামেনি। প্রতিদিন হামলার শিকার হচ্ছেন নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। যুদ্ধবিরতির পর নেতানিয়াহু বাহিনীর হামলায় গাজাজুড়ে প্রায় ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। একই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ফিলিস্তিনি। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরের ৭০ দিনে ইসরাইল প্রায় ৯০০ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার মিডিয়া অফিদের দাবি, ইসরাইল যুদ্ধবিরতির মানবিক শর্তগুলোর ৪০ শতাংশেরও কম বাস্তবায়ন করেছে, যা অবরুদ্ধ গাজার মানবিক সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের এমন অভিযোগের মধ্যেই সম্প্রতি দেশটির সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির বলেছেন, গাজায় ‘হলুদ রেখা’ নামে যে সীমারেখা বরাবর দখলদার বাহিনী পিছু হটেছে সেটিই এখন গাজা উপত্যকাকে ফিলিস্তিনিদের বাকি অধিকৃত ভূখণ্ড থেকে আলাদা করা এক নতুন সীমান্ত হিসেবে কাজ করবে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় অবস্থিত ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে আলাপকালে জামির বলেন, ইসরাইলি বাহিনী গাজার বিশাল এলাকার ওপর কার্যত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে এবং এই নিরাপত্তা রেখা বরাবর অবস্থান ধরে রাখার ইচ্ছে রয়েছে। তিনি হলুদ রেখাটিকে একটি অগ্রবর্তী নিরাপদ বেষ্টনী এবং একই সঙ্গে চলমান সামরিক কার্যকলাপের একটি ক্ষেত্র হিসেবে বর্ণনা করেন। মার্কিন মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে ইসরাইলি বাহিনী বর্তমানে এই সীমারেখার পেছনে অবস্থান করছে। তবে সেটি কার্যত গাজাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। আরও পড়ুন: যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজায় বিমান হামলা ইসরাইলের দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইল গত অক্টোবরেই এই হলুদ রেখাকে শক্তিশালী করতে সেখানে আউটপোস্ট, বালির বাঁধ, কাঁটাতার, হলুদ রঙের কংক্রিট মার্কার, ড্রোন ও সাঁজোয়া ইউনিট মোতায়েন করেছে। ফলে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও বাস্তবিক অর্থে গাজা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। যুদ্ধবিরতির এই ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যেও চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপ শুরু করার জন্য মধ্যস্থতাকারীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হামাস বলছে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশের সুবিধার্থে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম স্থগিত রাখার বিষয়ে আলোচনার জন্য তারা প্রস্তুত থাকবে। অন্যদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি বলেছেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের লক্ষ্য অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং হবে তবে এটি এই মাসের মধ্যেই শুরু হতে পারে। ইসরাইল কি সত্যিই যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইলের অতীত আচরণ দেখে মনে হচ্ছে না যে তারা সত্যিই যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে, বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়া এবং নেতানিয়াহুর বলা যে ‘যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি’ ইত্যাদি। সমালোচকদের মতে, গাজায় ইসরাইলের হামলা ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড অনেকটাই নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ ও সংকট মোকাবিলার জন্য করা হয়েছে। অর্থাৎ নিজের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত রাখতে তিনি এ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আরও পড়ুন: গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত, উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান মধ্যস্থতাকারীদের যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ে কী আছে? যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের মূল বিষয় হলো গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী শাসনব্যবস্থা। এরইমধ্যে গাজার শাসনব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত প্রস্তাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আংশিকভাবে সমর্থন দিয়েছে। ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী-প্রথম ধাপের পর হামাসকে গাজার শাসনক্ষমতা ছাড়তে হবে। একই সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে সংগঠনটিকে। তবে হামাস অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি নয়। এছাড়া গাজায় যে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতি মেনে না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা। এই সরকারে শুধুই ফিলিস্তিনিদের চায় হামাস। তারা বলছে, ফিলিস্তিনিরা মনে করছে, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে বাইরের দেশগুলো তাদের ইচ্ছামতো ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবে। তবে এই দুই বিষয়ে হামাসকে রাজি করানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, মিশর ও তুরস্ক। সংগঠনটিকে দেয়া এক প্রস্তাবে তারা বলেছে, প্রথমে হামাস রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ভারী অস্ত্র ত্যাগ করবে। পরে হালকা অস্ত্র সমর্পণ করবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্কিন কর্মকর্তার মতে, হামাস অস্ত্র সমর্পণের পরই কেবল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চাইছে ইসরাইল। এ বিষয়ে হামাস ও ইসরাইলের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীরা একটি সমঝোতায় পৌঁছালে ২০২৬ সালের শুরুর দিকে গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র: আল জাজিরা, টাইমস অব ইসরাইল, মিডল ইস্ট আই