তারেক রহমান ১৭ মিনিটের একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। লাখো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার মতো তিনি খেই হারাননি, লিখিত বক্তব্যও পাঠ করেননি। অথচ বক্তৃতার প্রতিটি অংশ ছিল উদ্দেশ্যনির্ভর, সংযত এবং পরিকল্পিত। তিনি কথা বলেছেন কম, কিন্তু বুঝিয়েছেন অনেক—ঠিক তাঁর মায়ের রাজনৈতিক ভঙ্গিমার মতোই। আবেগের বদলে যুক্তি, উত্তেজনার বদলে দায়িত্ববোধ—এই বৈশিষ্ট্যই তাঁর বক্তব্যকে আলাদা করে তুলেছে। ২. বর্তমান বাংলাদেশ এক ধরনের অদ্ভুত অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ‘পাবলিক’ নামের মব যখন-তখন মানুষ ধরে মারছে, বিগত সরকারের দোসর আখ্যা দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করছে। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর ঘটনাও কম নয়। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে একটি পরাজিত ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। যারা এসব বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছেন, তারাও নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। দীপুকে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা, ছায়ানট ও উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে আঘাত—এসবই উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর ধারাবাহিক তৎপরতার চিত্র। সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের আটকও করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—প্রায় পনেরো মাস ধরে এসব সহিংসতা পুরোপুরি থামানো যাচ্ছে না। ভূরাজনীতি ও নীরব কৌশল—বাংলাদেশ বহু ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। গত ৫৪ বছরে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির কৌশল মোকাবিলা করতে হয়েছে। এতে কোনো সরকার সফল হয়েছে, কেউ আবার পরাশক্তির চাপে নতি স্বীকার করেছে। ফলে দেশের কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা সবসময় পূরণ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্র পরিচালনায় গেলে প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হয়। তারেক রহমান অত্যন্ত সচেতনভাবে এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল উস্কানির বাইরে, ঐক্যের আহ্বানে কেন্দ্রীভূত। ৩.এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠ থেকে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি বা দিকনির্দেশনা শোনা যায়নি। নির্বাচন সামনে থাকা সত্ত্বেও চারপাশে ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তার আবরণ। বিশেষ করে ওসমান হাদী হত্যাকাণ্ড দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সারা দেশে যদি এর প্রতিক্রিয়া আরও নেতিবাচক হতো, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারতো। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সে প্রেক্ষাপটে ১২ তারিখ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। এই মোড় কোন দিকে যাবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতার ওপর। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত—ফলে বিএনপিই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। বড় দলের ক্ষেত্রে অহংকার বা রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য প্রত্যাশিত হতেই পারে। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তৃতায় কি সেই অহংকারের কোনো ছাপ ছিল? বরং তার বিপরীত চিত্রই উঠে এসেছে। অসুস্থ মাকে নিয়ে তারেক রহমানের ব্যক্তিগত বেদনা তো আছেই, পাশাপাশি একটি দলের কর্ণধার হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাটাও গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ নিয়ে তারেক রহমানের লন্ডন থেকে দেশে না ফেরাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন প্রোপাগান্ডা ও নিষ্ঠুর প্রচার চালানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—তাৎক্ষণিকভাবে দেশে না ফেরা কোনো অপরাধ নয়। সতেরো বছর ধরে তাঁর মায়ের জীবনে স্বস্তির কোনো সময় যায়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো তারেক রহমান রাজনীতিতে ধীরপায়ে, হিসেবি হয়ে এগোতে চাইছেন। ৩০০ ফিট এলাকার সমাবেশে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন— “আমার মা হাসপাতালে। স্বাভাবিকভাবে আমার সেখানে থাকার কথা। কিন্তু দেশ ও আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোও আমার দায়িত্ব।”এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি আবারও জনগণের সামনে নিজের দায়বোধের জায়গাটি পরিষ্কার করেছেন। ৪. ১৬–১৭ মিনিটের তাঁর বক্তৃতায় আধিপত্যবাদের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি সরাসরি কারও দিকে আঙুল তোলেননি, কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। পাকিস্তানি শাসনের দীর্ঘ আধিপত্য যে কীভাবে গণহত্যার দিকে নিয়ে গিয়েছিল—সে ইতিহাস তিনি ইঙ্গিতের মাধ্যমে স্মরণ করিয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত কিছু উত্তেজক শব্দ তিনি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। ফলে বক্তৃতা কোনোভাবেই উত্তেজনা বাড়ায়নি। বরং চলমান হিংসা ও মামলার সংস্কৃতি স্বাভাবিকভাবেই প্রশমিত হওয়ার একটি ইঙ্গিত এতে পাওয়া যায়। ৫.‘আমি’ থেকে ‘আমরা’—জনমুখী রাজনীতির ইঙ্গিত—তারেক রহমান তাঁর বক্তব্যে “আই হ্যাভ আ প্ল্যান” বলতে গিয়ে মার্টিন লুথার কিং-এর অনুকরণের কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন। এটি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং মানবিক ও নৈতিক নেতৃত্ব থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তিনি সচেতনভাবে ‘আমি’ শব্দটি এড়িয়ে ‘আমরা’-তে নিজেকে নিয়ে গেছেন। এতে তাঁর রাজনীতির জনমুখী রূপ স্পষ্ট হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, তিনি বিস্তারিত পরিকল্পনা বলেননি কেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই ঘোষিত—এবং নির্বাচনকে সামনে রেখেই তা জনগণের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ৬. ভূরাজনীতি ও নীরব কৌশল—বাংলাদেশ বহু ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। গত ৫৪ বছরে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির কৌশল মোকাবিলা করতে হয়েছে। এতে কোনো সরকার সফল হয়েছে, কেউ আবার পরাশক্তির চাপে নতিস্বীকার করেছে। ফলে দেশের কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা সবসময় পূরণ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্র পরিচালনায় গেলে প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হয়। তারেক রহমান অত্যন্ত সচেতনভাবে এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল উস্কানির বাইরে, ঐক্যের আহ্বানে কেন্দ্রীভূত। ৭.একটি প্রতীকী দিন, হয়তো সম্ভাবনার আলো—ব্রিটেন ও পশ্চিমা দেশগুলো যখন বড়দিনের উৎসবে মগ্ন, সেই দিনটিই বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বক্তব্যের জন্য। কাকতালীয় হলেও দিনটি বিএনপির জন্য ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে—এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।যা-ই হোক, দীর্ঘ অন্ধকার সময়ের ভেতর এই বক্তৃতা কিছুটা হলেও আলো জ্বালিয়েছে। সেই আলো যদি ছড়িয়ে পড়ে, তবে বাংলাদেশের আগামী সময় হয়তো আরও স্থিতিশীল, দায়িত্বশীল ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট। এইচআর/এএসএম