চলতি বছর বিশ্ববাসী যে কয়টা স্বল্পমেয়াদি সংঘাত প্রত্যক্ষ করেছে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ তার মধ্যে অন্যতম। এই যুদ্ধ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী হলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। হামলা ও পাল্টা হামলার মধ্যে চিরবৈরী দেশ দুটির মধ্যকার দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করে।গত ১৩ জুন ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্যেই, ইসরাইল হঠাৎ করে ইরানের বিরুদ্ধে বিনা উসকানিতে আগ্রাসন শুরু করে। জবাবে ইরানও ইসরাইলজুড়ে পাল্টা ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। একপর্যায়ে ২২ জুন আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করে তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ওই সংঘাতে জড়ায়। পরে ইসরাইলের পাশাপাশি কাতারে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আল উদেইদ বিমানঘাাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাতেই ২৪ জুন ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ১২ দিনের ওই সংঘাতে ইরানে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হন। যাদের মধ্যে সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং বেসামরিক নাগরিকও আছেন। অন্যদিকে ইরানের ড্রোন ও ব্যালিস্টক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। কয়েক দশক ধরে চলমান ইরান ও ইসরাইলের সাপে-নেউলে সম্পর্ক গাজা যুদ্ধের পর ব্যাপক সংঘাতে রূপ নেয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই হামলায় ইসরাইলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত এবং ২৫০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিন থেকেই গাজায় টানা বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরাইল। ইসরাইলসহ দেশটির পশ্চিমা মিত্রদের অভিযোগ, হামাসকে সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতা দেয় তেহরান। যদিও তেহরান বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করেছে। গাজা যুদ্ধের মধ্যেই ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরাইল। এতে বিপ্লবী গার্ডের দুই কমান্ডারসহ ৭ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হন। সেই হামলার জবাবে একই মাসের ১৪ তারিখ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে কয়েক ডজন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। একই বছরের ১ অক্টোবর ইসরাইলে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরাসরি হামলা করে ইরান। তেহরানের দাবি, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, লেবাননে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এবং আইআরজিসি জেনারেল আব্বাস নীলফোরৌশানকে ইসরাইল কর্তৃক হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে এই আক্রমণটি ‘আত্মরক্ষার’ পদক্ষেপ ছিল। একই মাসে ইসরাইল ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সুবিধাগুলোতে পাল্টা আঘাত হানে। আরও পড়ুন: ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আতঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন ইসরাইল ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ২০০৪ সালে দুই দফায় স্বল্প মাত্রার সংঘাতে জড়ানোর পর কথার লড়াই বাড়তে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি লাগাম টানার নিয়ে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। একপর্যায়ে এ নিয়ে ওমানের মধ্যস্থতায় তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পরোক্ষভাবে কয়েক দফা আলোচনা হয়। কিন্তু আলোচনা চলমান অবস্থাতেই ১৩ জুন রাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক কমান্ডারদের নিশানা করে নজিরবিহীন সামরিক হামলা শুরু ইসরাইল। ইসরাইলের হামলায় ইরান তার বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের হারিয়েছে। অনেক আইআরজিসি কমান্ডার ও সদস্যকে হারিয়েছে। দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক কেন্দ্র, সামরিক স্থাপনা, হাসপাতাল, জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র এবং বেসামরিক মানুষের ঘরবাড়িসহ অনেক অবকাঠামো আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। তাদের অনেক নিরপরাধ শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এমনকি নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, এই যুদ্ধে ইসরাইলের বিশাল জয় হয়েছে। তারা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক সক্ষমতা ও ব্যালিস্টিক মিসাইল সক্ষমতার অধিকাংশই ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল বলছে, ইরানের হামলায় তাদের ২৮ জন সাধারণ নাগরিক আর ১ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনার মৃত্যু হয়েছে। যদিও এই যুদ্ধে ইসরাইলের আহত ব্যক্তির কোনো হিসাব দেয়া হচ্ছে না। ইসরাইলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে দাবি করা হলেও অনেকে ইসরাইলের পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিএনএন পেন্টাগনের অনুসন্ধানের বরাতে জানা গেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন বোমাবর্ষণের ফলে দুটি স্থাপনার প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেছে, তবে এই হামলা ভূগর্ভস্থ ভবন ধ্বংস করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের চালানো হামলাগুলোর ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাস পিছিয়েছে। এর মানে, মাত্র কয়েক মাসেই ইরান তার নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম ঠিক আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মিডিয়ার একাধিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরাইলের অনেক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ইসরাইলের প্রধান সামরিক ও গোয়েন্দা লক্ষ্যবস্তু, কিরিয়া কম্পাউন্ড, আইডিএফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স স্কুল এবং ওয়েইজম্যান বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। আরও পড়ুন: ইরানে ফের হামলা চালাবে ইসরাইল? তাছাড়া ইসরাইলের সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি থাকা গাভ-ইয়াম নেগেভ প্রযুক্তি পার্ক, ইসরাইলের সবচেয়ে বড় পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্সে, হাইফার বাজান তেল শোধনাগার, হাইফা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও হার্জলিয়ার বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের সোরোকা মেডিকেল সেন্টারের কাঠামোগত ক্ষতি ও রাসায়নিক লিকেজ হয়েছে এবং এতে কয়েক ডজন লোক আহত হয়েছেন। পাশাপাশি ইসরাইলের রামাত গান, বাত ইয়াম, পেতাহ তিকভা, রিশন লে-সিওন, বেনে ব্রাক ও তামরা এলাকায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরাইলের হামলায় ইরানের তেহরানে বিস্ফোরণের পর ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। ছবি: এপি যুদ্ধবিরতির পরপরই ইসরাইলের স্থানীয় বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছিল, ইরানের হামলায় ইসরাইলের কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। ব্যক্তিগত ক্ষতিপূরণ চেয়ে সরকারের কাছে ৪১ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছিল, যার মধ্যে বাড়ির ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন পড়ে ৩৩ হাজার আর গাড়ি ও যন্ত্রাংশ ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন ৮ হাজার ইসরাইলি নাগরিক। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, ইসরাইলের পক্ষ থেকে তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি দাবি করা হলেও, তা মোটেই সঠিক নয়। এছাড়া ইরানে ইসরাইলের হামলার মূল লক্ষ্য যেটা বলা হয়েছিল, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া, সেটিও সম্ভব হয়নি বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই ইরান সম্ভবত অত্যন্ত সুরক্ষিত ও ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দোতে থাকা গোপন ফিসনযোগ্য পদার্থ সরিয়ে নেয়, যা ছিল দেশটির পুরো পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান বা মূল বিষয়। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ‘ডিক্যাপিটেশন’ বা মাথা কেটে ফেলা হয়নি বলেই ধরে নেয়া যায়। যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল ইরানের ওপর দ্রুততার সাথে আকাশে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারলেও, ডজন ডজন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বহুবার ইসরাইলের ভেতরে আঘাত হানে, যা দেশব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করে। এক সময় ইসরাইলের প্রতিরক্ষামূলক আয়রন ডোম সিস্টেমকে দুর্ভেদ্য মনে করা হলেও সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হানে। আরও পড়ুন: ইরানে যে কারণে হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন ট্রাম্প আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুই দেশের জ্যেষ্ঠ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য থেকেই বিষটির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম মারিভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের ধারণা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরাইলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে। অন্যদিকে ইসরাইল আবারও ইরানে হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইরানের সশস্ত্র বাহিনী যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশকে রক্ষা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তবে তেহরান যুদ্ধের চেয়ে কূটনীতির সমাধানকেই বেশি অগ্রাধকার দেয়। ইসরাইলের সঙ্গে জুনে ১২ দিনের যুদ্ধ ও চলমান উত্তেজনা প্রসঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নতুন করে ইসরাইলি হামলার খবর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ। আমরা শুনছি, ইসরাইল সরকার আবার হামলা চালাতে পারে। মনে হচ্ছে, তারা এখন মানসিক যুদ্ধেই ব্যস্ত। তারা ইরানে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছে, যা একটি বৃহত্তর যুদ্ধপরিকল্পনার অংশ হতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়াকে উল্লেখ করেছে। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।