বৈধ পথে যাচ্ছে গুটিকয়েক, অবৈধ পথে শত-সহস্র সমুদ্রপথে অভিবাসন ঠেকাতে চাই সচেতনতা আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া ঠেকানো সম্ভব নয় নিতে হবে নিজভূমে ফেরার কার্যকর উদ্যোগ রোকেয়া (৩৫)। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিজ ঘরের সামনে। অন্য সবার মতো দেখছেন, ঢাকা থেকে কারা যেন আসছে! কাছে গিয়ে কথা বলতেই নিজের সুখ-দুঃখ বলার পাশাপাশি জানান, সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য যেতে চান কানাডা বা আমেরিকা। তার ভাষায়, ‘আঁরার (আমাদের) ফোয়াইন গুন (ছেলে-মেয়েরা) এহন ছোডো ছোডো (এখনো ছোট)। ১০/১২ বছর অর (বয়স)। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা নইলে আমেরিকা; সেই দেশে যাইবার লাই (জন্য), যেই দেশত (দেশে) গেলে ফোয়াইনগুনের (ছেলে-মেয়েগুলোর) লেখাপড়া করিবার ফাইরবো (পারবে), ফয়দা (উপকার) অইবো, সুযোগ সুবিধা অইবো।’ বক্তব্যও এমন। আমেরিকা বা কানাডা যেতে চায়, যাতে সন্তানদের পড়ালেখা এবং ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে সুযোগ-সুবিধা পায়। একটু দূরে মাঠে বসে মোবাইলে সিনেমা দেখছিলেন একজন। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, নাম মোহাম্মদ জোহার (৩০)। দুই ছেলে, এক মেয়ে তার। কোনো কাজ নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকেন। রেশন যা দেয় তাতে চলে যায় দিন। অসুস্থ হলে হাসপাতালে চিকিৎসাও ফ্রি। নেট কিনে সিনেমা দেখে সময় পার করেন। তারও স্বপ্ন উন্নত কোনো দেশে সেটেল হওয়া। অবৈধ বা অনিয়মিত পথে অভিবাসনের জন্য বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যে কোনো মূল্যে সাগরপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া যেতে চেষ্টা করছে। তারা প্রায় দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ও আশপাশের দেশগুলোতেও অনিয়মিত পথে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।- ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম রোকেয়া, নেছারু বা জোহার শুধু নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বেশিরভাগের মধ্যেই জেগেছে এই স্বপ্ন। গত ১৫ নভেম্বর ২০২৫ (শনিবার) তিন থেকে চার ঘণ্টা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থেকে অন্তত ১২/১৫ পরিবারের কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। প্রত্যেকের মধ্যে এখন স্বপ্ন কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশে সেটেল হওয়ার। কেন এই চিন্তা তাদের মাথায় ঢুকেছে? জবাব খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায়, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম রোহিঙ্গা সমস্যা উদ্ভবের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে সেটেল করেছেন। এতে ক্যাম্পজুড়ে তৈরি হয়েছে উন্নত দেশে যাওয়ার স্বপ্ন। তবে নিরাপদ হলে নিজ দেশেও ফিরতে রাজি তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতটুকু হলে ঠিকই ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো- এই স্বপ্নজাগা তরুণদের কাজ নেই ক্যাম্পে। রেশনে কোনো রকম জীবন চলে। তাদের মধ্যে ঘুরপাক খায় উন্নত জীবনের হাতছানি। বৈধ পথে সুযোগ না পেলে পা পাড়ান অবৈধ পথেও। অবৈধ পথে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ার খবরও পাওয়া যায়। ‘সুরক্ষা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আশায় বিপজ্জনক যাত্রা’ ২৩ মে ২০২৫ তারিখে আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গাদের নৌকাডুবি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে ইউএনএইচসিআর। এতে উল্লেখ করা হয়, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর চলতি মাসের শুরুতে মিয়ানমারের উপকূলের কাছে ঘটে যাওয়া দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রাথমিক হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব ঘটনায় সাগরে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪২৭ জন রোহিঙ্গা। ২০২৫ সালে এ অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রায় অংশ নেওয়া প্রতি পাঁচজনের মধ্যে প্রায় একজনকে মৃত বা নিখোঁজ হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে। এতে আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরের জলরাশি বিশ্বে সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্রপথগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুটি আলাদা নৌকায় মোট প্রায় ৫১৪ জন রোহিঙ্গা যাত্রা করছিলেন। প্রথম নৌকাটিতে ছিলেন ২৬৭ জন। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে যাত্রা করেছিলেন, আর বাকিরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। নৌকাটি ৯ মে সাগরে ডুবে যায়। এতে মাত্র ৬৬ জন জীবিত উদ্ধার হন। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর ভেতরেই অনিয়মিত পথে সমুদ্রযাত্রা আর পাচার নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। সচেতনতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক সংস্থা—যেমন আইওএম, ইউএনএইচসিআর ও এনজিওগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে।-অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর দ্বিতীয় নৌকাটিতে ছিলেন ২৪৭ জন রোহিঙ্গা—যাদের মধ্যে কক্সবাজারের শিবিরের শরণার্থী ও রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিরাও ছিলেন। নৌকাটি ১০ মে উল্টে যায়। এতে মাত্র ২১ জন বেঁচে যান। এছাড়া ১৪ মে মিয়ানমার থেকে ছেড়ে আসা প্রায় ১৮৮ জন রোহিঙ্গা বহনকারী একটি তৃতীয় নৌকার খবরও পাওয়া যায়, যা মাঝপথে আটক করা হয়। প্রতিবেদনে ইউএনএইচসিআরের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক হাই কিয়ং জুন বলেন, ‘অর্থায়ন সংকটে আরও তীব্র হয়ে ওঠা ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ফলে নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আশায় ক্রমেই আরও বেশি মানুষ বিপজ্জনক যাত্রায় ঝুঁকছে। সাম্প্রতিক এই ট্র্যাজেডি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—বিশেষ করে প্রথম আশ্রয়দানকারী দেশগুলোতে কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করা, দায়িত্ব ভাগাভাগি ও সমুদ্রপথজুড়ে সম্মিলিত উদ্যোগ জীবন বাঁচাতে অত্যাবশ্যক।’ ‘সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা পাচার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ’ ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ বা অনিয়মিত পথে অভিবাসনের জন্য বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যে কোনো মূল্যে সাগরপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া যেতে চেষ্টা করছে। তারা প্রায় দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং আশপাশের দেশগুলোতেও অনিয়মিত পথে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে শীতকালে সমুদ্রপথে যাত্রার হার বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিতই এসব রোহিঙ্গাকে আটক করছে, কিন্তু পরিস্থিতি দিনদিন আরও জটিল হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘২০১০–১১ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপথে পাচার তীব্র আকার ধারণ করে এবং ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যেই দুই লাখের বেশি মানুষ সাগরপথে গেছে। ২০১৫ সালে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রকাশের পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আগমনের পর আবারও অনিয়মিত যাত্রা বাড়তে শুরু করে।’ স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও উন্নত দেশে যেতে চায়। সেখানে রাষ্ট্রহীন মানুষদের এই চাওয়াতে কোনো দোষ দেখি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার লোকও যায়নি। তাদের লোক সংখ্যা ১২ লাখ। প্রতিদিন নতুন করে একশোর মতো জন্ম হচ্ছে। তাদের তৃতীয় কোনো দেশে রি-সেটেলমেন্টের মাধ্যম এই সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব।- শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মিজানুর রহমান শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘শুধু রোহিঙ্গারাই নয়—তাদের সঙ্গে অনেক বাংলাদেশিকেও বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে মালয়েশিয়া নেওয়া হচ্ছে। জিম্মি করা, নির্যাতন, টাকা আদায়—এসব অপরাধ নিয়মিত ঘটছে। এমন কোনো মাস নেই, এমনকি সপ্তাহও নেই যখন এমন ঘটনা না ঘটে। সব মিলিয়ে সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা পাচার পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত ভয়াবহ ও নিয়ন্ত্রণ করা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’ আরও পড়ুনরোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক: মানবিক সংকট থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকিরোহিঙ্গা সংকটে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশরোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমার-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আরোপে প্রস্তুত বিশ্ব সম্প্রদায় তিনি বলেন, ‘মানবপাচার বিষয়ক মাসিক কোনো আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ না হলেও প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবপাচারের সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আলাদা করে নথিভুক্ত থাকে না। কারণ মামলা, আটক বা অপারেশনের হিসাব বিভিন্ন সংস্থা—পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড—নিজেরা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে।’ ‘এই পুরো বিষয়টিকে সংখ্যায় ধরে ফেলা সম্ভব নয়। এটি লাখো মানুষের জটিল ও পরিবর্তনশীল একটি বাস্তবতা। বৈধ বা অবৈধ পথে কতজন কোথায় যাচ্ছে—তা ট্র্যাক করা প্রায় অসম্ভব।’ যোগ করেন ব্র্যাকের এই অভিবাসন কর্মকর্তা। ‘সমুদ্রপথে পাচার ঠেকাতে তিন পরামর্শ’ সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের পাচার ঠেকাতে সচেতনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা—এই তিনটি একসঙ্গে কার্যকরভাবে প্রয়োগ না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন দাবি করে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর ভেতরেই অনিয়মিত পথে সমুদ্রযাত্রা আর পাচার নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। সচেতনতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক সংস্থা—যেমন আইওএম, ইউএনএইচসিআর ও এনজিওগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা বোঝায় যে এভাবে যাত্রা করা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সচেতনতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না।’ আসিফ মুনীর বলেন, ‘প্রতি বছর ঠান্ডার সময়ে যখন সমুদ্র শান্ত থাকে তখন পাচারের প্রবণতা বাড়ে। পাচারকারী চক্র অত্যন্ত সক্রিয়। তাদের বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক আছে, বিদেশেও আছে। তারা রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি যাত্রীদের টাকা নিয়ে রুট দেখায়, নৌকায় তোলে। ফ্রন্টলাইন ‘এজেন্ট’ শুধু বাহক; এর পেছনে আরও বড় গোষ্ঠী আছে যারা মূল লাভ তোলে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়। এই নেটওয়ার্ক ধরতে হলে আঞ্চলিক পর্যায়ে সমন্বয় ছাড়া উপায় নেই। আমাদের বর্ডার গার্ড, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও অন্য সংস্থা চেষ্টা করছে, কিন্তু পাচারকারীরা অনেক সময় নজর এড়িয়ে সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হচ্ছে। কোথাও নৌকা ডুবছে, কোথাও আটক হচ্ছে। সবকিছু ট্র্যাক করা সম্ভব হয় না।’ বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে কি না—এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তাই আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে সরাসরি দায়ী করা হয় না। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার নিয়ে টিআইপি রিপোর্টে (Trafficking in Persons Report) মূলত বাংলাদেশি নাগরিকদের পাচার, মামলা, আইন প্রয়োগ—এসবের ওপর নজর দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা ইস্যু সেখানে আলাদা করে আসে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আসবে না, তবে যদি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও বেশি করে পাচার হতে শুরু করে—তাহলে সেটি আমাদের জন্য ঝুঁকি। ২০১৫ সালের দিকে এ ধরনের ঘটনা বেশি দেখা গিয়েছিল। পরে কমেছে, কিন্তু সম্ভাবনা এখনো রয়ে গেছে।’ আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বালি প্রসেসসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক প্ল্যাটফরম আছে যেখানে দেশগুলো মানবপাচার ঠেকাতে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এসব প্রক্রিয়া খুব কার্যকর হয়নি। পাচারকারীরা যতটা তৎপর, আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ ততটা নয়।’ ‘তৃতীয় কোনো দেশে রি-সেটেলমেন্টের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান অসম্ভব’ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও উন্নত দেশে যেতে চায়। সেখানে রাষ্ট্রহীন মানুষদের এই চাওয়াতে কোনো দোষ দেখি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার লোকও যায়নি। তাদের লোক সংখ্যা ১২ লাখ। প্রতিদিন নতুন করে একশোর মতো জন্ম হচ্ছে। তাদের তৃতীয় কোনো দেশে রি-সেটেলমেন্টের মাধ্যম এই সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘তাদের আগে তাদের নিজভূম আরাকানে ফেরত নিতে হবে। এটাই আমরা চেষ্টা করছি। তবে উন্নত জীবনের আশায় বৈধ বা অবৈধ পথে কিছু রোহিঙ্গা বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। তবে এটা করা হলে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনকে নিরুত্সাহিত করা হবে। আমরা চাই, ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের নিজভূমে পুনর্বাসিত করা হোক।’ উন্নত দেশে কেমন আছে রোহিঙ্গারা? মো. ইসমাঈল (৬২)। আট বছরে আগে আরকান থেকে এসেছিলেন বাংলাদেশে। এ বছর (২০২৫) স্ত্রী, চার ছেলে-মেয়েসহ কানাডায় বৈধ অভিবাসী হয়েছেন। তাদের তিন পরিবারের ১২ জনকে গত বছরের এপ্রিলে কানাডায় সেটেল হতে সহযোগিতা করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এখন স্ত্রী সন্তান নিয়ে তিনি বেশ ভালো আছেন।’ একইভাবে দীর্ঘ আট বছরের সংগ্রামের পর গ্রিসের এথেন্সে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে মাহমুদ সুজি, তার স্ত্রী মরিয়ম এবং তাদের দুই ছেলে—মাহের ও মাহদি বৈধভাবে আশ্রয় পেয়েছেন। এ নিয়ে ১১ জুন ২০২৫ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে— ইউএনএইচসিআর। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় গ্রিক কাউন্সিল ফর রিফিউজিসের (GCR) কাছ থেকে আইনি সহায়তা পায় এই পরিবার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (ICRC) এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (IOM) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সুজি পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন নিয়ে একটি নতুন তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন গ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাতা আলেক্সিয়া সুনিনি। সেখানেও মাহমুদ এখন বেশ ভালো আছে বলেই উপস্থাপন করা হয়েছে। মাহমুদ ও ইসমাইলের মতো এ পর্যন্ত চার হাজার ৮৯৭ রোহিঙ্গা পুনর্বাসিত হয়েছে বিভিন্ন উন্নত দেশে। দীর্ঘ সময় ও ভোগান্তির পর তারা আসলেই ভালো আছে। কিন্তু সব রোহিঙ্গার মধ্যে যে উন্নত দেশের স্বপ্ন ঢুকেছে, সেটি কী সম্ভব? জবাবে কানাডার অভিবাসী রোহিঙ্গা মো. ইসমাঈল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৈধ পথে আসার সংখ্যা তো খুবই কম। তাও বিভিন্ন দেশ নিতে আগ্রহী হলে সিকিউরিটি রিস্ক, ডিজেবলিটি, মোস্ট ভার্নারেবল ও মেডিকেল ইস্যু বিবেচনায় বাছাই করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘সবারই তো ইচ্ছা থাকে মানসম্মত জীবনধারণের। ক্যাম্পের জীবন তো কোনো রকম বা নিম্নমানের। এই জীবন থেকে তো উত্তরণ সবাই চায়, চাইবেই। আমাদের তো আট বছর হয়ে গেছে এই ক্যাম্প জীবনে। আরাকানে ফেরার কার্যকর উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে, কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না। বরং আরাকানে নিপীড়ন আরও বেড়েছে। যার কারণে উন্নত জীবনের জন্য অন্য সবার মতো তারাও হয়তো উন্নত দেশে আসার কথা বলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাস্তবিক পক্ষে আমাদের আরাকানে ফেরত যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলে আমিও এখান (কানাডা) থেকে চলে যাবো। আমার বিশ্বাস সব রোহিঙ্গাই যাবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় হতাশ হচ্ছে ক্যাম্পে লোকেরা। তারা তো কোনো ভবিষ্যৎ দেখছে না।’ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটির বেশি শুধু ১২ লাখ রোহিঙ্গা নয়, বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতি রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাত কোটি ২০ লাখ, আর শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৭ লাখ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) প্রকাশিত ‘বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন ২০২৪’ বলছে, বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২৮১ মিলিয়ন (যা বিশ্ব জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৬)। যদিও বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখনো তাদের জন্মভূমিতেই বসবাস করে, তবুও ক্রমশ বেশি মানুষ, বিশেষত নিজেদের অঞ্চলের দেশগুলোতে, অন্য দেশে অভিবাসন করছে। কাজের সুযোগ আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের অভিবাসনের প্রধান কারণ, এবং অভিবাসী শ্রমিকরাই বিশ্বের আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের বৃহত্তম অংশ—যাদের বেশিরভাগ উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বসবাস করে। এসইউজে/এএসএ/এএসএম