ডিসেম্বর হোক জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ডিসেম্বর মাস একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ সময়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি শোষিত জনগোষ্ঠী অর্জন করেছিল রাষ্ট্রিক বিজয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর দাঁড়িয়ে আজ প্রশ্ন জাগে, এই বিজয় কি কেবল একটি তারিখে সীমাবদ্ধ, নাকি এটি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক জীবনে সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের যে ঐক্য, সহনশীলতা ও মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছিল, তা আজ জাতীয় বিভাজন, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার বাস্তবতায় বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বর কেবল একটি মাস হিসেবে নয়, বরং জাতিকে আবার এক কাতারে দাঁড় করানোর আহ্বান। বিজয় দিবসের স্মৃতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জাতীয় আত্মপরিচয়ের প্রকৃত শক্তি নিহিত ঐক্যের মধ্যেই, আর সেই ঐক্যই হতে পারে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ। মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না; এটি ছিল ভয়, নিপীড়ন, বৈষম্য ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ। লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, অসংখ্য পরিবারের ত্যাগ ও সীমাহীন কষ্টের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, তার মূল লক্ষ্য ছিল একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও সহনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেই লক্ষ্য বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কঠিন বাস্তবতা, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা জাতির ওপর গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতার ঘাটতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতার চাপ মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা ও হতাশা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পরিচালনার যে পর্যায়টি শুরু হয়, তার পরিণতিতে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক বিপর্যয় জাতির মানসিক কাঠামোতে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যা কেবল রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাই নয়, সমাজের আস্থার ভিতকেও নড়বড়ে করে দেয়। এর পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার ধারাবাহিক পালাবদল, সামরিক শাসনের উত্থান, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসন জাতিকে এক ধরনের স্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করে। গণতান্ত্রিক চর্চা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহনশীলতার বদলে ভয় ও প্রতিহিংসা প্রবেশ করে। ১৬ ডিসেম্বর আর শুধু ক্যালেন্ডারের একটি লাল দাগ হয়ে থাকবে না, কিংবা আনুষ্ঠানিক ফুল দেওয়া আর বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিজয়ের সেই দিন রূপ নেবে প্রতিদিনের জীবনের একটি গভীর উপলব্ধিতে, চিন্তায়, আচরণে ও দায়বদ্ধতায়। নাগরিকের নৈতিক অবস্থান, রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণতা এবং সমাজের পারস্পরিক সম্মানবোধে প্রতিফলিত হবে সেই বিজয়ের চেতনা। তখন স্বাধীনতা কেবল অতীতের গৌরব নয়, বর্তমানের দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশক হয়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগ তখন ইতিহাসের পাতায় বন্দী থাকবে না, বরং একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রতিদিনের প্রেরণা হিসেবে জীবন্ত হয়ে উঠবে। নাগরিকদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদের পরিবর্তে জন্ম নেয় শঙ্কা ও অনাস্থা, যা ধীরে ধীরে সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে পড়ে। এই ধারাবাহিক অস্থিরতা বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এমন এক মানসিক চাপ তৈরি করে, যার প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের রাজনৈতিক আচরণ ও সামাজিক সম্পর্কের ওপরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো এবার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সুস্থতা আসবে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেই প্রত্যাশা ভঙ্গ হয়। নির্বাচনব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন, রাজনৈতিক দমননীতি এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা সমাজে নতুন করে বিভাজন সৃষ্টি করে। ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের পরও যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা বাস্তবে রূপ পায়নি। বরং ঘৃণা ও প্রতিহিংসার ভাষা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এই দীর্ঘ ইতিহাসের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশি সমাজ এক ধরনের ধারাবাহিক মানসিক চাপে বাস করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং বারবার ভঙ্গ হওয়া প্রত্যাশা জাতিকে একটি স্থায়ী ট্রমার ভেতর ঠেলে দিয়েছে। এর ফল হিসেবে সমাজে সহনশীলতার বদলে জন্ম নিয়েছে আক্রোশ, যুক্তির বদলে অপমান এবং মতভেদের বদলে শত্রুতা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ঘৃণা ও প্রতিহিংসার বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখছে। সেখানে মতভেদ আর মতভেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং তা ব্যক্তিগত আক্রমণ ও প্রতিশোধের ভাষায় রূপ নিচ্ছে। সমাজ যদি এই অবস্থাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে তা মানুষের মানসিক সুস্থতা ও সামাজিক সহাবস্থানের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ঐতিহাসিক ও মৌলিক ইস্যুতেও আজ জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আবার কখনো তার বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান তৈরি হয়েছে, যা জাতীয় জীবনে বিভ্রান্তি ও বিভাজনকে আরও গভীর করেছে। মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী ঐক্যের ভিত্তি, কিন্তু বাস্তবে সেটিই হয়ে উঠেছে মতবিরোধ ও রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পুনর্লিখিত হয়েছে, কোথাও গুরুত্ব পেয়েছে কিছু ঘটনা, আবার কোথাও উপেক্ষিত হয়েছে অন্য অনেক সত্য। ইতিহাসের এই রাজনৈতিক ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং স্বাধীনতার আদর্শকে দলীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে। এর ফলে আগামী প্রজন্ম একটি সুস্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের পরিবর্তে পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যার মুখোমুখি হয়েছে। এই বিভ্রান্তি কেবল অতীত বোঝার ক্ষেত্রে নয়, ভবিষ্যতের পথচলায়ও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। ইতিহাস যখন সত্যের ভিত্তিতে নয়, ক্ষমতার প্রয়োজনে রচিত হয়, তখন তা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে আরও বিভক্ত করে তোলে, আর মুক্তিযুদ্ধের মূল মানবিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা ক্রমেই আড়ালে চলে যায়। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস হওয়ার কথা ছিল জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই দিনগুলোও দলীয় বিভাজনের শিকার। সরকারি ও বিরোধী শক্তি এক কাতারে দাঁড়িয়ে জাতির শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে, আমরা এখনো মুক্তিযুদ্ধের মূল শিক্ষাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছিল যে ঐক্যই প্রকৃত শক্তি, মানবিকতাই রাজনীতির মূল ভিত্তি এবং সহনশীলতাই একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজের প্রধান অলংকার। এই শিক্ষাগুলো ছিল কেবল যুদ্ধজয়ের কৌশল নয়, বরং একটি জাতির নৈতিক পথনির্দেশ। যদি আমরা সেই শিক্ষাগুলো বিস্মৃত হই, যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলীয় বিভাজন ও ক্ষমতার লড়াইকে মানবিক মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে স্থান দিই, তাহলে বিজয়ের সূর্য ধীরে ধীরে কেবল স্মৃতির আকাশেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে এবং তার আলো বাস্তব জীবনে পৌঁছাবে না। তখন স্বাধীনতা পরিণত হবে আনুষ্ঠানিকতা ও আবেগঘন স্মরণে, জীবনের আচরণ ও সিদ্ধান্তে তার কোনো প্রতিফলন থাকবে না। সমাজে বাড়বে অবিশ্বাস, সংকুচিত হবে সহমর্মিতা এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব আরও গভীর হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষা তখন ইতিহাসের পাতায় বন্দী হয়ে থাকবে, বাস্তব সমাজে তার কোনো কার্যকর উপস্থিতি থাকবে না। এই কারণেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে প্রতিদিনের চিন্তা, আচরণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে ধারণ করা অপরিহার্য। একমাত্র তখনই বিজয়ের আলো স্মৃতির গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের জীবনে, সমাজের সম্পর্কের ভেতরে এবং জাতির সামগ্রিক যাত্রায় স্থায়ীভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। আজকের প্রজন্মের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই ঘৃণা ও হিংসার চক্র থেকে সচেতনভাবে বেরিয়ে আসা এবং সমাজকে একটি সুস্থ, সহনশীল পথে ফিরিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে তার মূল নির্যাস জাতির সামনে তুলে ধরা এখন সময়ের দাবি, যাতে ইতিহাস বিভাজনের অস্ত্র না হয়ে শিক্ষার আলো হয়ে উঠতে পারে। মতভেদ থাকা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু সেই মতভেদ যেন কখনো শত্রুতায় পরিণত না হয়, সেটিই রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপক্বতার আসল পরিচয়। সমালোচনা অবশ্যই থাকবে, কারণ সমালোচনাই সমাজকে আত্মসমালোচনার সুযোগ দেয় এবং ভুল সংশোধনের পথ খুলে দেয়। তবে সেই সমালোচনা যদি ব্যক্তিগত আক্রমণ, অবমাননা বা সহিংসতার জন্ম দেয়, তাহলে তা সমাজের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব হলো ভিন্নমতকে সম্মান করতে শেখা, যুক্তির মাধ্যমে মত প্রকাশ করা এবং অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করা। কেবল তখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তব জীবনে অর্থবহ হয়ে উঠবে এবং বাংলাদেশ একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বিজয় তখনই সম্পূর্ণতা পাবে, যখন বাংলাদেশ একটি সহনশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। যে সমাজে ভিন্নমতকে শত্রুতা হিসেবে দেখা হবে না, যেখানে ন্যায়বিচার হবে ক্ষমতার ঊর্ধ্বে, আর মানবিক মর্যাদা থাকবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। সেখানে রাজনীতি হবে মানুষের কল্যাণের জন্য, প্রতিহিংসার জন্য নয়; মতভেদ থাকবে, কিন্তু তা ঘৃণায় রূপ নেবে না; ইতিহাস থাকবে সত্যের ওপর দাঁড়ানো, সুবিধার ওপর নয়। সেদিন ১৬ ডিসেম্বর আর শুধু ক্যালেন্ডারের একটি লাল দাগ হয়ে থাকবে না, কিংবা আনুষ্ঠানিক ফুল দেওয়া আর বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিজয়ের সেই দিন রূপ নেবে প্রতিদিনের জীবনের একটি গভীর উপলব্ধিতে, চিন্তায়, আচরণে ও দায়বদ্ধতায়। নাগরিকের নৈতিক অবস্থান, রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণতা এবং সমাজের পারস্পরিক সম্মানবোধে প্রতিফলিত হবে সেই বিজয়ের চেতনা। তখন স্বাধীনতা কেবল অতীতের গৌরব নয়, বর্তমানের দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশক হয়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগ তখন ইতিহাসের পাতায় বন্দী থাকবে না, বরং একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রতিদিনের প্রেরণা হিসেবে জীবন্ত হয়ে উঠবে। লেখক: কৃষিবিদ, গবেষক, কলামিস্ট ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন। এইচআর/এএসএম