জেন-জি বিক্ষোভে সরকার পতন, এখনও অস্থির নেপাল

দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ধারাবাহিকতায় নেপালে সরকার পতন অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যা চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাপক আকারের দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যদিয়ে সংঘটিত হয় যার নেতৃত্ব দেয় প্রধানত শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্ম যাদেরকে প্রায়ই জেনারেশন জেড বা জেন-জি বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।সরকার ও প্রশাসনে লাগামহীন দুর্নীতি, সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারগুলোর সীমাহীন ভোগবিলাস এবং সরকারি তহবিল তছরুফ ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ থেকে জনমনে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে রাস্তায় নামে তরুণরা। স্বতস্ফূর্ত সেই বিক্ষোভ দমনে কর্তৃপক্ষ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবসহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষোভের সময়ে ৭৭ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২ হাজার জন। যা আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করে। এভাবে মাত্র দুইদিনের আন্দোলনেই ঘটে সরকার পতনের মতো বিরাট ঘটনা। তীব্র চাপের মুখে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পাশাপাশি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তবে সরকার পতনের পর নতুন করে সরকার গঠিত হলেও এখনও শান্তি ফেরেনি নেপালে। যে কারণে বিক্ষোভ শুরু হয়  গত ৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন সরকার। নতুন নিয়মনীতি মেনে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হওয়া এবং মিথ্যা তথ্য ও হিংসাত্মক কনটেন্ট ছড়ানোর কারণ দেখিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নিয়ম মানায় টিকটকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল। মজার বিষয় হলো, এই পদক্ষেপটি সার্বভৌমত্ব ও নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতা জোরদার করার প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করলেও এটা একই সঙ্গে মতপ্রকাশ তথা বাত স্বাধীনতার হৃদয়েও আঘাত করে। সরকারবিরোধীরাও এমন অভিযোগ করেন যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি তুলে ধরার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাই এই নিষেধাজ্ঞার কারণ। দেশটির সচেতন মহল বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নেপো কিডস’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। এই হ্যাশট্যাগ দেশটিতে দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শীর্ষ ট্রেন্ডে পরিণত হয়। যেখানে মূলত সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার ও ছেলেমেয়েদের লাগামহীন ভোগ-বিলাসিতার দিকটি তুলে ধরে হয়। এই ‘নেপো কিড’ ট্রেন্ড জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকারী জেন-জিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্ষোভের জন্ম দেয়। আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২৫ / ইরানে হামলা চালিয়ে যেভাবে তোপের মুখে পড়ে ইসরাইল নেপালের জনসংখ্যার গড় বয়স ২৫ বছর, অর্থাৎ জনসংখ্যার একটি বড় অংশই জেন-জি প্রজন্মের এবং এরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। এই তরুণ প্রজন্মের কারণেই নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এক পরিসংখ্যা মতে, নেপালের ৪৮ শতাংশ মানুষের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট আছে, যেখানে মাত্র ৩৩.৭ শতাংশ ভারতীয়ের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট আছে। ফলে নেপালি নাগরিকদের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল মত প্রকাশের একটি হাতিয়ার নয় বরং তথ্য ও সংবাদের উৎস এবং এমনকি বিদেশে পারিবারিক যোগাযোগের প্রধান প্রবেশদ্বার। যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া কেবল ভিন্নমতই নয়, বরং বাক স্বাধীনতা এবং নাগরিক সাংবাদিকতাকেও ক্ষুণ্ণ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার কারণে নেপালের ব্যবসা ও পর্যটন খাতও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। এ কারণে এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে হাজার হাজার মানুষ, যাদের বেশিরভাগই তরুণ বা জেন–জি প্রজন্মের। বালেন্দ্র শাহ ও সুদান গুরুংয়ের নেতৃত্ব ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটটিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছিলেন সুদান গুরুং। তিনি যুবকেন্দ্রিক এনজিও হামি নেপালের সভাপতি। যে এনজিওটি ধীরে ধীরে একটি নাগরিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ভারতের আরেক সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইনস্টাগ্রামে দেয়া এক পোস্টে গুরুং নিশ্চিত করেন, তার প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে র‍্যালি আয়োজন করেছে। র‌্যালিতে শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্ম ও হাতে বই নিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। যা শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ব্ল্যাকআউটের আগে হামি নেপাল সামাজিকমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবাদ রুট ও নিরাপত্তা নির্দেশাবলী জানিয়ে দিত। সুদানের বার্তায় ছিল শৃঙ্খলা, অহিংসা ও প্রতীকের ওপর জোর। তিনি শিক্ষার্থীদের প্ল্যাকার্ড বা স্লোগান নয়, বরং স্কুল ইউনিফর্ম পরে বই হাতে নিয়ে ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। আন্দোলনের শুরু থেকেই এক্ষেত্রে আরও একটি নাম সামনে আসতে শুরু করে, তিনি হলের কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ। ভারতবিরোধী কিন্তু আমেরিকাবান্ধব এই মেয়র নিজ দেশের তরুণ সমাজের কাছে দারুণ জনপ্রিয় এক নেতার নাম। ছকভাঙা ব্যক্তিত্বের কারণে তরুণদের প্রিয়মুখ হয়ে উঠা এই বালেন্দ্র শাহ’ই নেপালের অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ নেপোকিড আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। দুইদিনের আন্দোলনে সরকার পতন ৮ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার বিক্ষোভকারী, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা প্রথম বড় আকারে রাস্তায় নেমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কাঠমান্ডু, পোখরা, চিতওয়ানসহ দেশের অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্টে ঢোকার চেষ্টার করলে পুলিশ জলকামান, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং তাজা গুলি ব্যবহার করে। এতে অন্তত ১৯ জন নিহত হন, আহত হন প্রায় ৫০০ জন। ওইদিন সন্ধ্যায় বিক্ষোভ দমন চলাকালীন হতাহতের জন্য দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক। রাতে জরুরি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সরকার। যোগাযোগমন্ত্রী পৃথ্বি সুব্বা গুরুং নিশ্চিত করেন, ‘শাটডাউন তুলে নেয়া হয়েছে … এখন তারা কাজ করছে।’ এছাড়া ১৫ দিনের তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরও আন্দোলন থামেনি। ৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়; রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। হামলার নিশানায় ছিল প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেল, নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা ও মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহলের বাসভবন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় নেপালের সামরিক বাহিনীর ১২টি বিমানে করে মন্ত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন করা হয় এবং ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে ভয়াবহ সহিংসতার মাঝেই পরিস্থিতি শান্ত করতে শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যেকোনো ধরনের সহিংসতা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। আমাদের অবশ্যই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।’ ভাষণে সন্ধ্যায় সর্বদলীয় বৈঠকের ডাক দেন তিনি। কিন্তু পর্দার আড়ালে ক্রমবর্ধমান চাপের মাঝে পড়ে যান ওলি। দেশটির সেনাবাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সকালের দিকে ওলি সেনাপ্রধান আশোক রাজ সিগদেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক সহায়তা চান তিনি। সিগদেল বলেন, তিনি (অলি) যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, তখনই সামরিক বাহিনী কেবল পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে পারে। শেষ পর্যন্ত অলি পদত্যাগে রাজি হন এবং প্রেসিডেন্ট পাউডেলের কাছে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে নেপালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর কেপি শর্মা অলির চতুর্থ মেয়াদের অবসান ঘটে। নতুন সরকার গঠন এরপর নেপালের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কীকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেন বিক্ষোভকারীরা। সরকার পতনের তিন দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন কার্কী। এরপর নেপালের প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। জানানো হয়, আগামী ৫ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নেপালের নির্বাচন কমিশনও সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখনও শান্তি ফেরেনি নেপালে। রাজনীতিতে বিরাজ করছে অস্থির পরিস্থিতি। গত মাসের শেষের দিকে নেপালে আবারও নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় জেন-জিরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বারা জেলায় কারফিউও জারি করে সরকার। এর মধ্যে নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়েও নতুন করে ক্ষোভ বাড়ছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ জানিয়েছে জেন-জিরা।