আমিনুল ইসলাম: স্নিগ্ধতার কবি

বেহুলার প্রেম, তিতুমীরের তেজ,এ মাটিতে মিশে আছে—প্রীতিলতার প্রাণ, জাহাঙ্গীরের যৌবন(আছে সংগ্রাম—আছে ভালোবাসা) আমিনুল ইসলামের (২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩) কবিতা গেইলের টি-টোয়েন্টি ইনিংসের মতো মার-মার কাট-কাট নয়। ব্রায়ান লারার টেস্ট ইনিংসের মতো স্নিগ্ধতার পরশ দেয়। আলতো করে কবজির মোচড় দিয়ে লারা যেমন বলকে সীমানা পার করে দেন; ঠিক তেমনই আমিনুল ইসলাম তার কবিতাকে স্নিগ্ধ পরশে পাঠকের কাছে ধরিয়ে দেন। এরপর উন্মাতাল সমর্থকের মতো আবেশ ছড়িয়ে দেয় কবিতাগুলো। ব্যাপিত হতে থাকে চক্রাকারে। তার কবিতায় বিদ্রোহের আগুন আছে, তবে চাপা দেওয়া আছে ঢেউটিনে। আমিনুল ইসলামের কবিতার নারীরা নদী হয়ে কথা বলে। কবি বলেছেন, ‘কখন তুমি আকাশ হলে/ অন্ত্যমিলের মোহনায়/ ঢেউয়ের কাছে জেনে দেখি/ নদীর কোনো দ্রোহ নাই’ (প্রেমের কবিতা)। কিংবা ‘চিঠির উত্তর দাও বা না দাও, ভালো তো বাসোই/ মুখে ‘না’ ‘না’ শব্দ নিয়ে গাল পেতে দাও—/ আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের সামনে’ (চুম্বন নিয়ে লেখা যে কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক) কী স্নিগ্ধতার প্রেমের বাণী। মনে হয় আমিই প্রেমিক! আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা ভালোবাসার রং ছড়িয়ে দেয় বাতাসে, আকাশে—সেগুলো পরে বর্ণালি হয়ে ওঠে। তার ভালোবাসার কবিতাগুলো হয়ে ওঠে একেকটি তাজমহল-যমুনা। সব মিলিয়ে দৃশ্যে কিংবা সুবাসে হয়ে ওঠে নন্দনকানন। আমিনুল ইসলাম লক্ষ্য করলেন নারীর স্নিগ্ধতা, শান্তি ও সৌন্দর্য। ‘ফ্রয়েডীয় রাস্তার বেণীমাধব মোড়ে’, ‘নষ্টামির সার্বভৌমত্ব ফেলে—নত হয় তোমার মিনারে’, ‘একদিন বরেন্দ্রের ভাতের সুঘ্রাণে’ ইত্যাদির মতো চিত্র বা চিত্রকল্প পাঠককে প্রেমের কাঙাল করে তোলে। কবি আমিনুল ইসলাম কবিতা সাহিত্যে একটি চিরন্তন প্রিয়তমা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। আরও পড়ুনহ‌ুমায়ূন আহমেদ: সময়ের প্রতিচ্ছবিজাহেদা খানমের শিশুসাহিত্যে শিক্ষণীয় দিক তার কবিতায় নারী সংবেদনশীল, শরীর নিয়ে কথা হলেও তা ধরাছোঁয়ার বাইরে, রক্ত-মাংসের বাস্তব নারী নয়। তার নায়িকারা মূলত সৌন্দর্য-বিলাসী কিন্তু দেহতাতীত। দেবসুলভ সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায়। অনির্দিষ্ট প্রেমের প্রতি প্রবল অনুরাগ: ‘আমি একটি নদী কিনতে পারি/ কিন্তু তাতেই খালি হয়ে যায় পকেট;/ তোমার কাছে যা আছে তা দিয়ে তুমি একটা/ পাহাড় কিনতে পারো—/ কিন্তু তার বেশি কিছু নয়;/ অতএব এসো, আমরা দুজনে মিলে/ একটা পাহাড় এবং একটি নদী কিনে ফেলি;/ তখন সমুদ্রটা ফ্রি পেয়ে যাবো’(আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসবো, কেন?)। আমিনুল ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কিংবা ভৌগলিক কবিতাগুলো ঘুমপাড়ানির গল্প শোনায়। তবে ঘুমপাড়ানি গল্পের মতো নিছক নয়—আছে ভূগোলের কিংবা ইতিহাসের প্রকৃত-কাহিনি। তার কবিতার ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা ভূগোলের জ্ঞান কিংবা উপলব্ধির প্রয়োগ কবিতাগুলোকে করেছে সমৃদ্ধ। নানা অবিচার কিংবা অনাচারে কবিতাগুলো হয়েছে বোধ-জাগ্রতের আধার। কখনো প্রহসন, কখনো হাস্যরসাত্মক ভঙ্গি উদ্দেশ্যের ঠিক যথার্থ স্থানে পাঠককে নিয়ে যায়। স্যাটায়ার কবিতাগুলো অন্যায়কারীর বুকে শেল বিদ্ধ করে দিতে সক্ষম। কবির ইচ্ছেশক্তির কথাগুলো অবলীলায় বলে দেন। গভীরে পৌঁছে দেয় বার্তাগুলো। ভাষা ও চিত্রকল্প কিংবা প্রতীকগুলো গড়ে ওঠে স্নিগ্ধতার পরশে। আমিনুল ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য-ভূগোল ইত্যাদির আবহ কিংবা চিত্রকল্প পাঠকের মানসে ভেসে ওঠে যথার্থ ছবি। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ছবি মিলিয়ে কখনো হয়ে ওঠে বড় একটি চিত্রকর্ম। সেখানে শব্দগুলো হয়ে ওঠে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন অবয়বের। মূর্ত হয়ে ওঠে মানসপটে। মানসপটে চিত্র সৃষ্টির ক্ষমতা আমিনুল ইসলামের কবিতার একটি বড় গুণ। এই দক্ষতার ওপরই কবি কিংবা কবিতার কালজয়ী হওয়ার অন্যতম প্রধান উপায়। আমিনুল ইসলামের কবিতার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা তাকে ‘স্নিগ্ধতার কবি’ হতে আপত্তি করবে না। বরং জোরালো আবেদনই করবে—আমিনুল ইসলাম—স্নিগ্ধতার কবি কিংবা স্নিগ্ধ কবি। এসইউ/জেআইএম