বিয়েতে মেহেদি পরা আজকের নয়, ৫০০০ বছরের ঐতিহ্য

বাঙালি উপমহাদেশের বিয়ের আয়োজন মানেই রং, গান, আড্ডা, আনন্দ, খাওয়া-দাওয়া, সাজসজ্জা আর নানা আচার-অনুষ্ঠানের সমাহার। এর মধ্যে মেহেদি আজ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশেষ করে কনের সাজে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, বিয়েতে মেহেদি কি কেবল সৌন্দর্য বাড়ানোর অনুষঙ্গ, নাকি এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও ইতিহাস? আসুন ঘুরে আসি ইতিহাসে অলিগলি থেকে, জেনে আসি মেহেদি লাগানোর চর্চা শুরু হলো কবে, কখন, কোথা থেকে। মেহেদি মূলত ‘হেনা’ গাছের পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে তৈরি এক ধরনের প্রাকৃতিক রং। প্রাচীনকাল থেকেই মেহেদি ত্বক শীতল রাখা, ক্ষত সারানো এবং সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সময়ের প্রবাহে মেহেদি শুধু প্রসাধনের উপকরণে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে বিয়ে ও উৎসবকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, মেহেদির ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রাচীন মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেও মানুষ শরীর রাঙাতে এবং গরম আবহাওয়ায় শীতলতা পেতে হেনা ব্যবহার করত। মিশরের সমাধিতে পাওয়া প্রমাণে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির হাত-পা মেহেদি দিয়ে সাজানো হতো যা শুভ লক্ষণ ও সম্মানের প্রতীক বলে মনে করা হতো। পরে পারস্য ও আরব সভ্যতার হাত ধরে এই রীতির বিস্তার ঘটে এবং ধীরে ধীরে তা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়েতে মেহেদির প্রচলন ব্যাপক আকার ধারণ করে মূলত মুঘল আমলে। মুঘল দরবারে নারীদের সাজসজ্জায় মেহেদি ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রাজপরিবারের আচার থেকে এই রীতি ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনেও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে মেহেদি দ্রুত ধর্ম ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে বিয়ে ও উৎসবের দিনে এটি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামি ঐতিহ্যেও মেহেদির উল্লেখ রয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ থেকেই আঙুল, হাত ও চুলে মেহেদি ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়। এখান থেকেই মুসলিম সমাজে এটি আনন্দের দিনগুলোর অংশ হয়ে ওঠে। আবার হিন্দু সমাজে কনের হাতে মেহেদির গাঢ় রংকে সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। ফলে ধর্মীয় চর্চা, সামাজিক বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক আচার মিলেই মেহেদি বিয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। বিয়েতে মেহেদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। অনেকের মতে, মেহেদি শুভ শক্তির প্রতীক এবং কনের হাতে মেহেদির রং যত গাঢ় হয়, দাম্পত্য জীবন তত সুখী হয়। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, মেহেদি কনেকে কুদৃষ্টি ও অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি বিয়ের আগের দুশ্চিন্তা কমাতে এবং শরীর ঠান্ডা রাখতে মেহেদি কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে প্রচলিত ধারণা রয়েছে। মেহেদি অনুষ্ঠান এখন শুধু কনের সাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি একটি সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন ‘মেহেদি নাইট’ একটি আলাদা উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিয়ের আগে আলাদা অনুষ্ঠান করে গান, নাচ, গল্প আর হাসির মধ্য দিয়ে মেয়েরা একসঙ্গে মেহেদি পরেন। এতে বিয়ের আনন্দ আরও রঙিন হয়ে ওঠে। গান-বাজনা, নাচ আর হাসি-মজার মধ্য দিয়ে কনে ও তার পরিবারের জন্য এটি এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতির সময়। এই আয়োজন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় করে। আগে মূলত কনের হাত ও পায়ে মেহেদি লাগানো হলেও আধুনিক সময়ে এই চর্চা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এখন বর, বান্ধবী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও মেহেদি পরছেন। এর ফলে মেহেদি অনুষ্ঠান বিয়ের আনন্দকে সবার মাঝে ভাগ করে নেওয়ার একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে মেহেদির নকশাতেও এসেছে পরিবর্তন। ঐতিহ্যবাহী ফুল-লতা, ময়ূর কিংবা জ্যামিতিক নকশার পাশাপাশি এখন জনপ্রিয় হয়েছে আরবি ডিজাইন, রাজস্থানি ও মুঘল মোটিফ, এমনকি বর-কনের নাম বা বিয়ের তারিখ লেখা বিশেষ নকশা। এসব নকশাকে অনেকেই প্রতীকী অর্থের সঙ্গে যুক্ত করেন। যেমন- ফুল নতুন জীবনের প্রতীক, লতা সম্পর্কের স্থায়িত্ব বোঝায়। কোথাও কোথাও কনের হাতে বরের নাম লুকিয়ে আঁকা হয়, যা আবার অনুষ্ঠানে মজার খেলা হিসেবেও দেখা যায়। আধুনিক দুনিয়ায় মেহেদির ডিজাইন ও স্টাইলে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আরবিয়ান, ইন্দো-পাক, গালফ স্টাইল, এমনকি গ্লিটার ও স্টোন দিয়ে সাজানো ডিজাইনও জনপ্রিয় হয়েছে। তবে মূল উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে কনেকে তার বিশেষ দিনটিতে আরও সুন্দর ও অনন্য করে তোলা। তবুও নকশা যত আধুনিকই হোক না কেন, মেহেদির সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আজও অটুট রয়েছে। বলা যায়, মেহেদি এখন আর কেবল হাতের নকশা নয়, বরং বিয়ের আবেগ, আনন্দ ও শুভকামনার প্রতীক। বিয়েতে মেহেদি নিঃসন্দেহে সাজসজ্জার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এটি কেবল ফ্যাশন বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সামাজিকতার গভীর সম্পর্ক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান এই রীতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় শুভকামনা, ভালোবাসা এবং নতুন জীবনের আশীর্বাদ। আরও পড়ুনগ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিয়ের আয়োজন কি হারাতে বসেছেযেখানে সবাই মেলায় জীবনসঙ্গী খোঁজে, বিয়ের আগেই মা হয় মেয়েরা কেএসকে