বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু বছর ধরেই একটি বিশেষণ ঘুরে ফিরে উচ্চারিত হয়- আপসহীন। এই শব্দটির সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যে নামটি জড়িয়ে গেছে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিরোধী রাজনীতির প্রধান মুখ এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে ও কেন্দ্রের বাইরে সমান দৃঢ়তায় অবস্থান করা এই নেত্রী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নাম। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে বহুবার উঠে এসেছে- খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কখনোই একচুল পিছু হটেননি। প্রশ্ন হলো, সেই অবস্থানগুলো কী? যার কারণে তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ বলা হয়? সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনদীর্ঘ সামরিক শাসনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। এতে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। সে সময় রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা বহাল রেখে ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত রাখার সুযোগ থাকলেও তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, ক্ষমতা কুক্ষিগত না করে গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্তই ছিল তার আপসহীন রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় দৃষ্টান্ত। জাতীয়তাবাদী অবস্থান২০০১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির জটিল বাস্তবতায়ও তিনি জাতীয়তাবাদী পররাষ্ট্রনীতিতে অনড় থাকেন। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র- এই ত্রিমুখী কৌশলগত সম্পর্কের মধ্যেও সরকারের নীতিগত অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তনে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। নির্বাসনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান২০০৭ সালের ১/১১ পরবর্তী জরুরি অবস্থায় রাজনীতির সবচেয়ে সংকটময় সময়ের মুখোমুখি হন খালেদা জিয়া। সে সময় তার সামনে দেশ ছাড়ার প্রস্তাব আসে। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত তার আপসহীন মানসিকতার সবচেয়ে দৃঢ় প্রকাশ। সমঝোতা প্রত্যাখ্যান২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি হন খালেদা জিয়া। কারাদণ্ডের সময়ও তিনি রাজনৈতিক সমঝোতার পথে যাননি। বিভিন্ন মহল থেকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিনিময়ে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ এলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজনৈতিক আপস করলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ মিলতে পারতো। কিন্তু তিনি সে পথ বেছে নেননি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির ওপর দমন-পীড়নের চিত্র উঠে এসেছে। এসময় খালেদা জিয়াও দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকা, চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক যোগাযোগে বাধার মুখে পড়েন। বিএনপিতে নেতৃত্ব ও ভারসাম্যদলের ভেতরে নেতৃত্বের ভারসাম্য রক্ষায়ও খালেদা জিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তারেক রহমানের লন্ডনভিত্তিক নেতৃত্ব ও দলের কেন্দ্রীয় কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখতে তিনি ছিলেন শেষ ভরসা। বিএনপির রাজনীতি আজও তার আপসহীন অবস্থান দিয়েই সংজ্ঞায়িত। সমর্থকদের কাছে খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি হাল না ছাড়ার প্রতীক। চাপের মুখে মাথা নত না করা, কড়া অবস্থান নেওয়া এবং দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইমেজই তাকে আলাদা করে তুলেছে। ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান ইয়াহিয়া বলেন, দেশ ও জাতির স্বার্থে তিনি কখনো আপস করেননি বলেই মানুষ তাকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে জানে। জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, খালেদা জিয়া আজীবন দেশ, মা ও মাটির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানীর ভাষ্য, গণতন্ত্রের জন্য কারাবরণ করেও তিনি ক্ষমতার সঙ্গে আপস করেননি- এই সংগ্রামী জীবনই তাকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিএনপির সহ-সংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম জানান, জনগণ ও দেশের স্বার্থে তিনি কখনো আপস করেননি। স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য তার সংগ্রাম ইতিহাসের অংশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রাজনীতি বিশ্লেষক মোবাশ্বর হোসেন টুটুল বলেন, জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল আদর্শ বহুদলীয় গণতন্ত্র তথা জনগণের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বেগম জিয়া সব প্রতিকূলতার বিপরীতে যেই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা দেখিয়েছেন সেটা বাংলাদেশের বিরাজমান অনান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিপরীতে উনার ব্যক্তিত্বকে আপসহীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। বারবার ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ওয়াদা করেছেন তা থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। এবং এ কারণে বাংলাদেশের আপামর জনগণ বেগম জিয়ার ওপর নিঃসংকচে আস্থা স্থাপন করে উনাকে নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একজন অকুতোভয় আইকন হিসেবে বিশ্বাস করে। লোভ, ভয়, জুলুম ও অত্যাচারের মতো নিপিড়নমূলক কোনো পদক্ষেপই উনাকে উনার অবস্থান থেকে কখনোই টলাতে পারেনি। এটাই হচ্ছে উনার রাজনৈতিক ক্যারিশমা। কেএইচ/একিউএফ/জেআইএম