বেগম খালেদা জিয়াকে কেন ‘আপসহীন’ নেত্রী বলা হয়?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে “আপসহীন নেত্রী”—এই খেতাবটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় বেগম খালেদা জিয়ার নামের আগে। কিন্তু কেন? কোন কোন ঘটনা তাকে এই পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে? ফিরে যাবো সেই ইতিহাসে—যেখানে আছে সামরিক শাসনের বিরোধিতা, আন্দোলন, গ্রেপ্তার, গৃহবন্দী আর নির্বাচনী লড়াইয়ের টানাপোড়েন।১️. রাজনীতিতে প্রবেশ: ব্যক্তি জীবনে বিপর্যয়ের পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ একজন নারী—দুই সন্তান নিয়ে নিজেকে খুঁজে পান ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্যে।এরপর এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের মধ্যেই রাজনীতির মাঠে নামেন বেগম খালেদা জিয়া।১৯৮৪ সালে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন—যে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল ভয়, দমন আর সেনাশাসনের ছায়ায় ঢাকা। অনেক ইতিহাসবিদ বলছেন— এই সিদ্ধান্তই ছিল তার “আপসহীন চরিত্রের” প্রথম বড় প্রকাশ।২️. এরশাদবিরোধী আন্দোলন: আপসহীন লড়াইয়ের প্রধান ধাপ ১৯৮০-এর দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিবাদ ছিল ৭-দলীয় জোটের। এই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালে প্রথম বড় আন্দোলনে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৮৪ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৮৭ সালে প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় থেকেও তিনি আন্দোলন থামতে দেননি। ইতিহাসবিদরা বলেন, এসময়ে কোনো সামরিক সরকারের সঙ্গে আপস না করাই ছিল তার রাজনৈতিক অবস্থানের মেরুদণ্ড। এ কারণেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অন্যতম “আপসহীন নেতা” বলে অভিহিত করেন। আরও পড়ুন: যে তিন মেয়াদে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম জিয়া৩️. ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কঠোর অবস্থান১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে, শেখ হাসিনার পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বের মুখ। দেশবাসী চাইছিল গণতন্ত্র ফিরুক, সেনাশাসনের ইতি ঘটুক। এই আন্দোলনে তিনি কোনো ব্যাকডোর ডিল বা ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে আপস করেননি। অবশেষে এরশাদের পতন ঘটে, এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পথ তৈরি হয়। ৪️. ১৯৯১ নির্বাচন: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়, এবং বেগম খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তার মেয়াদেই বাংলাদেশ প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠনে তার “অটল অবস্থান”–এর ফল। তখনও বলা হচ্ছিল, তিনি এমন নেতা যিনি স্টেট পলিসিতে কখনো আপস করবেন না।৫️. ২০০১–২০০৬: রাজনৈতিক চাপ, জোট রাজনীতি ও বিরোধীদের সাথে দ্বন্দ্বেও কঠোর অবস্থান২০০১–২০০৬ মেয়াদে তিনি নানা রাজনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধের মুখোমুখি হন। বিরোধীদের দাবি, জোট রাজনীতি, এমনকি আন্তর্জাতিক মিত্রদের চাপ— কোনো ক্ষেত্রেই তিনি সহজে সমঝোতায় আসেননি। অনেক বিশ্লেষক বলেন, তার “নীতি ও সিদ্ধান্তে কঠোরতা” এ সময় আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরও পড়ুন: যেভাবে গৃহবধূ থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া৬️. ২০১৩–২০১৮: গ্রেফতার, গৃহবন্দি , রাজনৈতিক চাপ— তবু নীতিগত অবস্থানে কঠোরতা২০১৩ ও ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল তার ওপর বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমঝোতার চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তার দল জানিয়ে দেয়, তিনি আপসের রাজনীতি করেন না।২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় দণ্ড পাওয়ার পর, কারাবাস ও অসুস্থতার মাঝেও তিনি সরকারের প্রস্তাবিত বিকল্প সমঝোতা গ্রহণ করেননি। এই অবস্থানেই তার “আপোসহীন” পরিচয় আরও প্রতিষ্ঠা পায়।রাজনীতিতে “আপোসহীনতা” কারও মতে শক্তি, কারও মতে বিতর্কিত। তবে ইতিহাস বলছে, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ, সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা এবং আপস না করার নীতির ওপর।