বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া নিজেই একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাস আপসহীনতার, সেই ইতিহাস অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার দৃঢ়তার। তবে এই অর্জনের অপর পিঠে আছে জীবনভর চড়া মূল্য দেয়ার করুণ সব গল্প। ৪৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উতড়াইতে হারিয়েছেন আবাসস্থল এমনকি সন্তানহারা হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে তার জীবনে। শিক্ষাবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাই আপসহীন করেছে খালেদা জিয়াকে। আপসহীনতার এমন দৃষ্টান্ত তৃতীয় বিশ্বতো বটেই গোটা দুনিয়াতেই বিরল।দশকের পর দশক গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সম্মুখভাবে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। অসীম দেশপ্রেম, দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতায় তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির এক অনন্য চরিত্র। গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রনায়কে উত্তরণের এই পথে চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। গণতন্ত্র, মাটি ও মানুষের প্রশ্নে আপসহীন এই নেত্রী চার দশকের পথচলায় হয়ে ওঠেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তার নামের সঙ্গে নব্বইয়ের দশকেই জুড়ে যায় ‘আপসহীন’ শব্দটি। একাশির ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ৮২ সালে জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপির হাল ধরেন বেগম জিয়া। সহজাত দৃঢ়তায় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের আসনে আসীন হন বেগম জিয়া। সেই সময় স্বৈরাচার এরশাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ’৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়-অবিচল। সেই দৃঢ়তা পতন ডেকে আনে এরশাদের। সব সমীকরণ পাল্টে দিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনে দেশের জনগণ। সময়ের পরিক্রমায় ওয়ান ইলেভেনে আবারও খড়গ নেমে আসে বেগম জিয়ার ওপর। মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় নানা চাপের কাছেও নতি স্বীকার করেননি তিনি। দেশ ত্যাগে অস্বীকৃতি জানান বেগম জিয়া। আরও পড়ুন: বেগম খালেদা জিয়াকে কেন ‘আপসহীন’ নেত্রী বলা হয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী সময় সংবাদকে বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। মিথ্যা মামলায় তাকে জেল খাটতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনও কোনো আপস করেননি। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আব্দুল হাই শিকদার বলেন, বেগম জিয়ার চাইতে দীর্ঘ সময় শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে অবিরাম সংগ্রাম করে যাওয়া কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি আপস করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। তাকে জেল খাটতে হত না। তিনি অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিহিংসার রাজনীতি তার বাড়িটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। খালেদা জিয়ার আপসহীন সংগ্রাম ওয়ান ইলেভেনেই শেষ হয়নি। ভোটবিহীন ক্ষমতায় জেঁকে বসা শেখ হাসিনার পতন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বিনিময়ে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে অশ্রুসিক্ত হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে বেগম জিয়াকে। হারাতে হয়েছে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে। নির্বাসনে পাঠানো হয় বড় ছেলে তারেক রহমানকেও। উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয় বছরের পর বছর। আর সব বাদ দিলেও রাষ্ট্রের সিনিয়র এই সিটিজেনকে অন্যায়ভাবে কারাগারে রাখা হয় দীর্ঘ দিন। আরও পড়ুন: যেভাবে গৃহবধূ থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া রাষ্ট্রের কল্যাণে গোটা একটি জীবন বেগম খালেদা জিয়া উৎসর্গ করেছেন উল্লেখ করে আব্দুল হাই শিকদার বলেন, রাষ্ট্রের কল্যাণে গোটা একটি জীবন উৎসর্গ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্রের প্রতি তার যে অটুট শ্রদ্ধা আর কমিটমেন্ট, সেটা থেকে তিনি কখনও সরেননি। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য তিনি তার জীবনটা উৎসর্গ করেছেন। আর ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরীর মতে, জাতীয়তাবাদের দর্শনই আপসহীন করে তুলেছে খালেদা জিয়াকে, যা তৃতীয় বিশ্বতো বটেই সারা বিশ্বে বিরল-অনন্য। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন আপসহীন নেত্রী। তার জীবনে, তার কর্মে আপস বলে কিছু নেই। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।