গৃহবধূ থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতির সব উত্তাল সময়ে খালেদা জিয়া ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে—কখনো সমাদৃত, কখনো তীব্র সমালোচনায় ঘেরা। স্বাধীনতার পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের চড়াই-উতরাই—সবকিছুরই এক অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতির অর্ধশতক বারবার উচ্চারিত নাম খালেদা জিয়া, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। দেশের প্রথম জনপ্রতিনিধিভিত্তিক প্রধানমন্ত্রীও তিনি। পারিবারিক নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দীর্ঘদিনের বিএনপি চেয়ারপারসন এবং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অপরিহার্য চরিত্র। ব্যবসায়ী পিতার ঘরে জন্ম, সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে বিয়ে, স্বাধীনতাযুদ্ধের বন্দিদশা, অল্প বয়সে বিধবাবস্থা, সন্তানদের লালন—তারপর রাজনীতিতে অভিষেক; খালেদা জিয়ার জীবন যেন বাংলার রাজনীতির এক চলমান উপাখ্যান। জলপাইগুড়ি থেকে মুদিপাড়া, গৃহবধূ থেকে নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়িতে। পিতা ইস্কান্দার মজুমদার, মাতা তৈয়বা মজুমদার—দিনাজপুরের মুদিপাড়ার পরিবার। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান খালেদা খানম পুতুল দিনাজপুরেই পার করেছেন শৈশব-কৈশোর। দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময় বিয়ে হয় ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। ১৯৬৫ থেকে ’৬৯ পর্যন্ত করাচি, তারপর জয়দেবপুর-চট্টগ্রাম ঘুরে সংসার জীবন। দুই ছেলে—তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। যুদ্ধের দিনগুলো: আত্মগোপন, গ্রেফতার, বন্দিজীবন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় ফেরত। বড় বোনের বাসা, এরপর সিদ্ধেশ্বরী—২ জুলাই পাক সেনারা তাকে এবং দুই ছেলেকে আটক করে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দিজীবন কাটে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। জিয়াউর রহমানকে হারিয়ে রাজনীতির মাঠে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জীবনের বড় আঘাত সামলে দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় নতুন লড়াই। তখনো তিনি পুরোদস্তুর গৃহবধূ; রাজনীতির ছায়াও স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা ও দলের ডাক তাকে রাজনীতির ময়দানে নামতে বাধ্য করে।১৯৮২ সালে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। দ্রুতই নেতৃত্বগুণে সবার নজর কাড়েন। ১৯৮৪ সালে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন—এবং প্রায় ৪১ বছর টানা দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী ১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বে সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠন; ১৯৮৬ পর্যন্ত এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন; ১৯৮৭ সালে ‘এরশাদ হটাও’ একদফা আন্দোলনের ঘোষণা; আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তেও তার অবস্থান বদলায়নি—আন্দোলন থামেনি। তার কঠোরতা, আপসহীন অবস্থান ও সংগঠিত নেতৃত্বের ফলে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম জনপ্রতিনিধিভিত্তিক প্রধানমন্ত্রী। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধিতার কেন্দ্রে থাকা নেত্রী ১৯৯১, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) এবং ২০০১—তিনবার সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণ এশিয়ার সার্কের চেয়ারপারসনও ছিলেন দুবার। বিরোধীদলের কঠিন রাজনীতি, ক্ষমতায় আসা-যাওয়া, জোট রাজনীতি—সবকিছুর কেন্দ্রেই ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তার সরকারগুলো বহুল সমালোচিত—দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ইত্যাদি নিয়ে নানা আলোচনায় ছিলেন তিনি। এ সমালোচনার জের ধরেই বিভিন্ন মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দিও হতে হয়েছে। তবুও রেকর্ড তার পক্ষেই—পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে লড়াই করে সব কটিতেই জয়। ওয়ান-ইলেভেন, গ্রেফতার, মামলার জট ও রাজনীতির অনিশ্চয়তা ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতার। প্রায় এক বছর পর আদালতের আদেশে মুক্তি। নির্বাসনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে—তিনি অভিযোগ করেন বলপ্রয়োগের; সরকার বলে স্বেচ্ছা ত্যাগ। এর আগে ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৭—এই তিনবার এরশাদ আমলেও গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরিবার: রাজনীতির ভারপ্রাপ্ত, অনুপস্থিত একটি নাম বড় ছেলে তারেক রহমান এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো—২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারের সেই শোক তাকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে নাজুক করে তোলে। উত্তরাধিকার: সংগ্রাম, বিতর্ক, ইতিহাসের অংশ বাংলাদেশের রাজনীতির সব উত্তাল সময়ে খালেদা জিয়া ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে—কখনো সমাদৃত, কখনো তীব্র সমালোচনায় ঘেরা। স্বাধীনতার পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের চড়াই-উতরাই—সবকিছুরই এক অপরিহার্য অংশ তিনি। তার জীবন ইতিহাসের কাছে একদিকে সংগ্রামী নারীর উঠে দাঁড়ানো, অন্যদিকে ক্ষমতার রাজনীতির বিচিত্র অধ্যায়; যেখানে রয়েছে সাফল্য, বিতর্ক, ব্যথা আর অনমনীয় জেদ—সব মিলেই ‘খালেদা জিয়া’ নামটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিধানে এক স্থায়ী রেখা এঁকে রেখেছে। কেএইচ/ইএ/জেআইএম