বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন এক অনন্য ও শক্তিশালী অধ্যায়। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেই সঙ্গে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরবও অর্জন করেন। পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময়জুড়ে রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনীতি, শিক্ষা, অবকাঠামো, নারীর ক্ষমতায়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।২০০১–২০০৬ মেয়াদ: রাষ্ট্র পরিচালনায় কাঠামোগত পরিবর্তন ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-চারদলীয় জোট সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠা করে। উদ্দেশ্য ছিল—ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সন্ত্রাস দমন এবং জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একই মেয়াদে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্নীতির নেতিবাচক ভাবমূর্তি দূর করতে গঠন করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার আইনি কাঠামো দেওয়া হয় এবং দুর্নীতিবিরোধী জনমত গঠনে গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়। অর্থনীতি ও শিল্পখাতে এই মেয়াদে বেসরকারি খাত, সমবায় ও প্রবাসী বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। গার্মেন্টস শিল্পে নারী কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ সহায়তা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি পাট, চা, বস্ত্র, চিনি, ওষুধ, সিরামিক ও চামড়া শিল্প রক্ষায় নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নারী উদ্যোক্তা ও শিক্ষিত যুবকদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা বাড়ানো হয়। কৃষিখাতে উৎপাদন ব্যয় কমানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষক-ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে নকলমুক্ত পরীক্ষা, মেয়েদের বিনামূল্যে পড়াশোনা, শতাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও উন্নীতকরণ এবং মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বাড়াতে শ্রমঘন শিল্প, সমবায় আন্দোলন ও আত্মকর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হয়। বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাড়ানো হয়। আরও পড়ুন: বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের অনন্য ১০ রেকর্ড যোগাযোগ ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এই মেয়াদে দেশের সব প্রধান মহাসড়ক উন্নয়ন, বড় নদীতে সেতু নির্মাণ, চট্টগ্রামে নিউমুরিং টার্মিনাল, রেলওয়ের আধুনিকায়ন, মেঘনা ও ধলেশ্বরী সেতু, কর্ণফুলীর তৃতীয় সেতু প্রকল্পে অগ্রগতি এবং পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। ২০০১ সালে সাবমেরিন কেবল সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তথ্য মহাসড়কে যুক্ত হয়। একই সময়ে মোবাইল ফোন গ্রাহক সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় তিন কোটিতে পৌঁছে। পরিবেশ সুরক্ষায় পলিথিন ব্যাগ ও দুই-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ, বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন নারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, চাকরিতে অগ্রাধিকার, যৌতুক ও এসিড সন্ত্রাস দমন, নারী ও শিশু পাচার রোধ এবং মাতৃ-শিশু মৃত্যুহার কমাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি–মার্চ): রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করতে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে তিনি পদত্যাগ করেন এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেন—যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বিরল নজির। ১৯৯১–১৯৯৬: অর্থনীতি ও শিক্ষায় ভিত্তি নির্মাণ প্রথম মেয়াদে তার নেতৃত্বে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। ভ্যাট ব্যবস্থা চালু, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ও সিকিউরিটিজ কমিশন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুশাসনের কাঠামো তৈরি হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৪.৫ শতাংশে পৌঁছায়, যেখানে এরশাদ আমলে ছিল ১.৮ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের বৃত্তি ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা চালু হয়। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ১,২৫৫ ইউনিয়নে বিস্তৃত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের তালিকাভুক্তি পাঁচ বছরে প্রায় ৩০ লাখ বৃদ্ধি পায়। আরও পড়ুন: ‘পুতুল’ থেকে প্রধানমন্ত্রী: যেমন ছিল বেগম জিয়ার ছোটবেলা ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল,'Now as Prime Minister, Mrs. Zia -- in contrast with Benazir Bhutto when she first became Prime Minister of Pakistan -- is aggressively promoting education and vocational specially of girls.' কর্মসংস্থান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০-৯৫ সময়ে তৈরি পোশাক খাতে কর্মসংস্থান ২৯ শতাংশ বাড়ে। কারখানার সংখ্যা তিনগুণের কাছাকাছি বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় গোর্কির সময় তিনি সরাসরি উদ্ধার তৎপরতায় নেতৃত্ব দেন। তার আহ্বানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী অংশ নেয় ‘অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল’-এ। পরবর্তীতে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সব মিলিয়ে, বেগম খালেদা জিয়ার রাষ্ট্রনায়কসুলভ সিদ্ধান্ত, নীতিগত সংস্কার ও মানবিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র উচ্চতা তৈরি করেছে—যার প্রভাব আজও দৃশ্যমান।