বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কম নেতাই আছেন, যাদের জীবন একাধারে ক্ষমতা, সংঘাত, সংগ্রাম ও বিতর্কে ভরা। খালেদা জিয়া সেই বিরল নামগুলোর একটি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়া এমন এক নাম, যাকে বাদ দিয়ে গত চার দশকের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গল্প বলা যায় না। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের দীর্ঘদিনের নেতা, আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত এক শাসক সব মিলিয়ে ইতিহাসের বিচারে তিনি একটি জটিল ও বহুমাত্রিক চরিত্র। প্রশ্ন হলো, সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ইতিহাস তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তবে তার জীবনপথের দিকে তাকালে কিছু রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায়। তার পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মধ্যবিত্ত ও রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তার জীবনের প্রথম পর্ব ছিল মূলত পরিবারকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ। ১৯৬০ সালে তার জীবন মোড় নেয় এক ঐতিহাসিক সম্পর্কে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এই বিয়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজনীতির কেন্দ্রের সঙ্গে, যদিও তখনো তিনি ছিলেন মূলত একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, তার যুদ্ধকালীন ভূমিকা সবকিছুই খালেদা জিয়ার জীবনে নীরব কিন্তু গভীর ছাপ ফেলে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে তার জীবন ছিল অপেক্ষাকৃত আড়ালেই। ১৯৭৫ সালের পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করলেও তিনি রাজনীতির সামনের সারিতে ছিলেন না। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একজন গৃহিণী ও রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী থেকে তিনি হঠাৎই হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের কেন্দ্রীয় চরিত্র। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। সেই শূন্যতায় খালেদা জিয়াকে সামনে আনা হয়। অনেকের চোখে তিনি তখন ছিলেন ‘প্রতীকী নেতা’, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে। ১৯৮৪ সালে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন হন এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে রাজপথের রাজনীতিতে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া ইতিহাস গড়েন। তার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়কে অনেকেই গণতন্ত্রে ফেরার অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আরও দুই দফা তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। বিশেষ করে ২০০১ সালের সরকার ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী সময়। তবে তার শাসনামল কেবল সাফল্যের গল্প নয়। দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দমন এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগও তার নামের সঙ্গে যুক্ত। জঙ্গিবাদ মোকাবিলা নিয়ে সরকার যেমন প্রশংসা পেয়েছে, তেমনি শাসনব্যবস্থার নানা দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দীর্ঘ দ্বন্দ্ব। এই দুই নেত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে দীর্ঘ সময় ধরে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখে। সংসদ বর্জন, হরতাল-অবরোধ, রাজপথের আন্দোলন সব মিলিয়ে এই দ্বন্দ্ব একদিকে গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের ভাষা তৈরি করেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় স্থবিরতার কারণও হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে খালেদা জিয়া দুই পুত্রের মা তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন এবং বর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তিনি। কোকোর মৃত্যু খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে গভীর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাবরণ করার পর খালেদা জিয়া কার্যত সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অসুস্থতা ও আইনি জটিলতায় তার রাজনৈতিক উপস্থিতি সীমিত হয়ে আসে। এই সময় বিএনপির নেতৃত্ব সংকট আরও প্রকট হয়, যা দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইতিহাসের দৃষ্টিতে খালেদা জিয়াকে এককভাবে বিচার করা কঠিন। তিনি একদিকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে বিতর্কিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশীদার। তিনি একজন নারী নেতা হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন, আবার একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাতের সংস্কৃতির অংশও হয়েছেন। সময় হয়তো তার শাসনামলের ভুল-ত্রুটি ও সাফল্য দুটোকেই আলাদা করে বিচার করবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অনিবার্য অধ্যায়। তাকে ভালো বা মন্দ যেভাবেই মূল্যায়ন করা হোক, তার উপস্থিতি ছাড়া দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইতিহাস হয়তো শেষ পর্যন্ত তাকে মনে রাখবে এমন একজন নেত্রী হিসেবে, যিনি রাজনীতিতে আসেননি পরিকল্পনা করে, কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি তাকে রাজনীতির কেন্দ্রেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আরও পড়ুনবড়দিনের রাতে থেমে গিয়েছিল যুদ্ধআয়ু শেষ হলে জাহাজের ভাগ্যে কী ঘটে জানেন? কেএসকে