বেগম খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দীপ্তিমান অধ্যায়

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক অনিবার্য শূন্যতার মুখোমুখি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই—একটি সময়ের সমাপ্তি ঘটেছে, আবার একটি নতুন সময়ের কঠিন প্রশ্নও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব থাকে, যাঁদের উপস্থিতি কেবল দলীয় সীমারেখায় আটকে থাকে না; তাঁদের অনুপস্থিতি রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্বে—জাতির স্মৃতিতে—একটি বড় ফাঁক তৈরি করে। খালেদা জিয়ার প্রয়াণ সেই অর্থেই শুধু একটি মৃত্যু নয়; এটি বাংলাদেশের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের ইতি। খবরের ভাষ্য অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বর(২০২৫) ভোর ছয়টার দিকে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান—খবরটি তাঁর দল বিএনপি ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা-ও বোঝায়—তিনি শুধু বিএনপির ‘‘ঐক্যের প্রতীক’’ নন, বহু মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতার এক অনিবার্য নাম। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যে বিশেষণটি যুক্ত হয়েছে, তা হলো—‘‘আপসহীন’’। এই শব্দটি কেবল আবেগের অলংকার নয়; বরং বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত, অনাস্থা, আন্দোলন, নির্বাচনবিরোধিতা, কারাবাস, অবরুদ্ধতা—সব মিলিয়ে এক কঠোর বাস্তবতার ভেতর দিয়ে এই বিশেষণটি নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই প্রধান ধারার দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাসে তিনি ছিলেন একদিকে গণআন্দোলনের প্রতীক, অন্যদিকে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা নারী নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক বৃহৎ চরিত্র। ইতিহাসের নির্মমতা হচ্ছে—বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেক অর্জনই ‘‘অর্জন’’ হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে থাকে না; তার ওপর বিতর্ক, পাল্টা-বিতর্ক, দলীয় স্মৃতির সংঘর্ষ জমে ওঠে। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় প্রায় সর্বজনস্বীকৃত—তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁর উত্থান ছিল সেই সময়ের দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপটে একটি বড় ঘটনা। খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশকে অনেকেই ‘‘পরিকল্পিত ক্যারিয়ার’’ হিসেবে দেখেন না; বরং এটিকে দেখা হয় এক ধরনের ঐতিহাসিক চাপ ও পরিবার-রাজনীতির উত্তরাধিকার থেকে তৈরি হওয়া অনিবার্য পথ হিসেবে। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির নেতৃত্ব-শূন্যতা, দলকে টিকিয়ে রাখা, আন্দোলনের নতুন কাঠামো নির্মাণ—সব মিলিয়ে তিনি ধীরে ধীরে দলের কেন্দ্রীয় অক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। এখানে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের একটি দিক গুরুত্বপূর্ণ- তিনি বক্তৃতার চেয়ে বেশি ভরসা রাখতেন দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান ও প্রতীকী স্থিতির ওপর। রাজনীতিতে কখনও কখনও ‘‘ক্যারিশমা’’ মানে শুধু শব্দের জাদু নয়; কখনও কখনও ক্যারিশমা মানে হলো—ভয়, চাপ, মামলা, কারাবাসের মধ্যেও একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা। তাঁর সমর্থকেরা সেখানেই তাঁকে ‘‘আপসহীন’’ বলে দেখেছেন; সমালোচকেরা আবার এই দৃঢ়তা ও অনমনীয়তার রাজনৈতিক মূল্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এই দ্বৈত পাঠই একজন বড় নেতার স্বাভাবিক পরিণতি। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনকে এক লাইনে ধরতে গেলে বলা যায়—এটি ছিল আন্দোলন ও রাষ্ট্রক্ষমতা—দুই ক্ষেত্রেই দীর্ঘ পথচলার জীবন। তিনি ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন এবং পরে আরও মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেছেন; একই সঙ্গে বিরোধী রাজনীতির মঞ্চেও তিনি ছিলেন দীর্ঘদিনের বড় মুখ। তাঁর শাসনামলের মূল্যায়নও একরৈখিক নয়। একদিকে আছে শিক্ষা ও সামাজিক কিছু অগ্রগতির আলোচনাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা; অন্যদিকে আছে জোট রাজনীতির বিতর্ক, ক্ষমতার রাজনীতিতে সংঘাত-সংকট, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে ‘‘জটিল’’ বলেই চিহ্নিত করেছে—কারণ একই ব্যক্তিত্বের মধ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের স্মৃতি আছে, আবার রাষ্ট্রক্ষমতার চর্চায় বিতর্কও আছে। তবু একটি বিষয় অস্বীকার করা যায় না—খালেদা জিয়া ছিলেন এমন এক নেতা, যাঁকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতির দশকজুড়ে প্রধান বয়ান আবর্তিত হয়েছে। ‘‘বিরোধ বনাম সরকার’’, ‘‘আন্দোলন বনাম দমন’’, ‘‘ভোট বনাম বর্জন’’—এসব রাজনৈতিক অভিধান যেন বহুদিন তাঁর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে। খালেদা জিয়ার শেষ দিকের রাজনৈতিক জীবন ছিল অনেকাংশেই কারাবাস, মামলার ভার, অসুস্থতা ও সীমিত উপস্থিতির জীবন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিবরণ অনুযায়ী, দুর্নীতির মামলায় তাঁর কারাদণ্ড হয়; পরে স্বাস্থ্যগত কারণে ২০২০ সালের পর তিনি কার্যত রাজনীতিতে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তাঁর সমর্থকেরা বরাবর এসব মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন, আর বিরোধী পক্ষের বয়ানে এটি ছিল ‘‘আইনি বিচারপ্রক্রিয়া’’—এই সংঘর্ষ বাংলাদেশে বিচার ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও বহু প্রশ্নকে সামনে এনেছে। তাঁর জীবনের এই অধ্যায়টি—এক অর্থে—বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে করুণ অধ্যায়গুলোর একটি, যেখানে ব্যক্তিগত অসুস্থতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার টানাপোড়েন পাশাপাশি চলেছে। মৃত্যুর পর একজন রাজনৈতিক নেতার পরিচয় নতুন করে লেখা হয়। জীবদ্দশায় যে নেতাকে মানুষ দলীয় চশমায় দেখে, মৃত্যুর পর অনেক সময় তাঁকে দেখা হয় একটি বৃহত্তর ইতিহাসের অংশ হিসেবে। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও সেই ঘটনাই ঘটছে। শোকবার্তাগুলোতে যেমন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে, তেমনি প্রকাশ পায় একটি স্বীকৃতি—তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এখানে একটি কঠিন সত্যও আছে- খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপির জন্য প্রতীকের রাজনীতি বদলে যাবে। কারণ দীর্ঘদিন তিনি শুধু চেয়ারপারসন ছিলেন না; তিনি ছিলেন দলের ভেতরে-বাইরে এক ধরনের ‘‘শেষ আশ্রয়’’—যাঁর নামেই বড় সিদ্ধান্তগুলো শেষ পর্যন্ত বৈধতা পেত। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও ইঙ্গিত করেছে যে তাঁর মৃত্যুর পর বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামো ও ভবিষ্যৎ কৌশল নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হবে। খালেদা জিয়ার মহাপ্রয়াণ বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি প্রশ্ন রেখে যায়—প্রথমত, রাজনীতি কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতীক থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হবে? দ্বিতীয়ত, জনপ্রিয় দলীয় রাজনীতির শক্তি কি নীতি-ভিত্তিক কর্মসূচিতে পুনর্গঠিত হবে, নাকি আবেগ-ভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই আবার নতুনভাবে মাথা তুলবে? তৃতীয়ত, রাষ্ট্র কি এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারবে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে—কিন্তু প্রতিহিংসা, অবরোধ, দমন-পীড়নের চক্র কমবে? খালেদা জিয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠ সম্ভবত এখানেই—বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস বারবার সংকটে পড়েছে, আবার বারবারই নতুন করে পথ খুঁজেছে। কখনও আন্দোলনে, কখনও নির্বাচনে, কখনও সমঝোতায়, কখনও সংঘাতে—দেশ এগিয়েছে। একজন নেতা চলে যাওয়ার পর জাতি নতুন করে বোঝে—ব্যক্তি অপরিহার্য নন, কিন্তু ব্যক্তিত্বের শূন্যতা রাজনৈতিক সমাজকে নাড়িয়ে দেয়। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক শুধু দলীয় নয়—এটি এক ধরনের জাতীয় শোক, কারণ তিনি ছিলেন দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক স্মৃতির অংশ। তাঁর জীবন যেমন বিরোধী রাজনীতির সংগ্রামকে ধারণ করেছে, তেমনি রাষ্ট্রক্ষমতার জটিলতা, সমালোচনা ও বিতর্কও ধারণ করেছে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের নায়কও, বিতর্কের চরিত্রও—কিন্তু সর্বোপরি তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতিনিধি। আজ যখন আমরা ‘‘খালেদা জিয়ার মহাপ্রয়াণ’’ লিখি, তখন কেবল প্রশংসা কিংবা কেবল সমালোচনা দিয়ে তাঁকে ধরা যায় না। তাঁকে ধরতে হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের পুরো উত্থান-পতনের ক্যানভাসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে এই নয় যে ইতিহাসের সব দ্বন্দ্ব মুছে ফেলতে হবে; বরং শ্রদ্ধা জানানো মানে হলো—একজন বড় নেতার জীবনকে সত্যের আলোয়, ভারসাম্যের চোখে, সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখা। তিনি চলে গেলেন। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক শুধু দলীয় নয়—এটি এক ধরনের জাতীয় শোক, কারণ তিনি ছিলেন দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক স্মৃতির অংশ। তাঁর জীবন যেমন বিরোধী রাজনীতির সংগ্রামকে ধারণ করেছে, তেমনি রাষ্ট্রক্ষমতার জটিলতা, সমালোচনা ও বিতর্কও ধারণ করেছে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের নায়কও, বিতর্কের চরিত্রও—কিন্তু সর্বোপরি তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতিনিধি। আজ যখন আমরা ‘‘খালেদা জিয়ার মহাপ্রয়াণ’’ লিখি, তখন কেবল প্রশংসা কিংবা কেবল সমালোচনা দিয়ে তাঁকে ধরা যায় না। তাঁকে ধরতে হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের পুরো উত্থান-পতনের ক্যানভাসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে এই নয় যে ইতিহাসের সব দ্বন্দ্ব মুছে ফেলতে হবে; বরং শ্রদ্ধা জানানো মানে হলো—একজন বড় নেতার জীবনকে সত্যের আলোয়, ভারসাম্যের চোখে, সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখা। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন একটি তীব্র প্রশ্ন—বাংলাদেশ কি এবার এমন একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবে, যেখানে নেতৃত্ব ব্যক্তির মহিমা নয়, প্রতিষ্ঠানের শক্তি হয়ে উঠবে? এই প্রশ্নের উত্তরই হয়তো আগামী দিনের ‘‘নতুন বাংলাদেশ’’কে সংজ্ঞায়িত করবে। লেখক : সেক্রেটারি, ইক্যুমেনিক্যাল খ্রিষ্টান ট্রাস্ট-ইসিটি, ঢাকা। এইচআর/জেআইএম