মাঠজুড়ে ধানের ‘নাড়া’ গ্রামাঞ্চলের চিরচেনা দৃশ্য

কামরুল হাসান হৃদয় পৌষের শীতল সকাল নামলেই গ্রামাঞ্চলে চোখে পড়ে চিরচেনা দৃশ্য। যতদূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে ধানগাছের অবশিষ্টাংশ বা গোড়া। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘নাড়া’। পৌষ মাসে ধান কেটে নেওয়ার পর মাঠজুড়ে থাকা এই নাড়া নীরবে জানায়, আরেকটি কৃষিবর্ষের অধ্যায় শেষ হয়েছে। একসময় এই নাড়া ছিল গ্রামীণ জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ধানগাছের খড় দিয়েই তৈরি হতো খড়ের ঘর। বর্ষা, গ্রীষ্ম ও শীত—সব ঋতুতেই এসব ঘরেই কাটতো মানুষের জীবন। সময়ের পরিবর্তনে খড়ের ঘর আজ বিলুপ্তপ্রায়। গ্রামেও উঠে গেছে ইট-সিমেন্টের ভবন। তবু নাড়া এখনো টিকে আছে গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিজীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ কৃষিজমিতে এখনো ধানই প্রধান ফসল। চলতি মৌসুমে ধান ঘরে তোলার পর কৃষকেরা কিছুদিন জমিতে নাড়া রেখে দেন। এরপর জমি চাষ দিয়ে প্রস্তুত করা হয় পরবর্তী ফসলের জন্য। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এসব জমিতে অন্য ফসল চাষ করা হয়। এই ধারাবাহিক চাষাবাদই গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখছে। নাড়া শুধু ধান কাটার পর পড়ে থাকা অবশিষ্টাংশ নয়। গবাদিপশু নির্ভর এ অঞ্চলে নাড়া থেকে তৈরি খড় গরু ও ছাগলের প্রধান খাদ্য। অনেক খামারি নাড়া সংগ্রহ করে খড়ের পালা বানিয়ে সারাবছর সংরক্ষণ করেন। খড়ের বাজারদর বাড়লে এই নাড়া কৃষকের বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবেও কাজ করে। পৌষের শীতের সাথে নাড়া ঘিরে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ জনপদের বহু স্মৃতি। একসময় শীতের সকাল ও সন্ধ্যায় নাড়া কেটে জড়ো করে আগুন পোহানো ছিল গ্রামবাংলার চিরচেনা চিত্র। সেই আগুন ঘিরেই বসতো গল্পের আসর। আলোচনায় আসতো হাটের খবর, ফসলের হিসাব আর গ্রামের সুখ-দুঃখ। আরও পড়ুনমিরসরাইয়ে চলছে আমন ধান কাটার উৎসব আমন ধানে অচেনা রোগ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় চাষিরা  প্রবাস ফেরত মো. রাকিব মিয়া জানান, শৈশবে সকাল-সন্ধ্যা নাড়া কেটে আগুন পোহানো ছিল তাদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ। এখন শহরের যান্ত্রিক জীবনে সেই উষ্ণতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঠে দাঁড়িয়ে নাড়া দেখলেই চোখে ভেসে ওঠে শৈশবের দিনগুলো। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার পর ইঁদুরের গর্ত থেকে পড়ে থাকা ধান কুড়িয়ে বিক্রি করতো গ্রামের শিশুরা। তখন বেপারিরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধানের ওজনে জিলাপি দিতো। সঙ্গে থাকতো রসপোয়া ও গুলগুলা। এই ছোট ছোট আনন্দই ছিল গ্রামীণ শৈশবের বড় পাওয়া।’ কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো স্বচ্ছলতা নেই। একসময় গোলাভরা ধান থাকতো। নিজেদের খাওয়ার পরও বিক্রি করা যেত। এখন অনেক সময় পরিবারের খাবার নিশ্চিত করতেই হিমশিম খেতে হয়।’ কৃষি সংশ্লিষ্টদের মতে, কৃষিপদ্ধতির আধুনিকায়নের ফলে খড়ের ঘর হারিয়ে গেলেও নাড়া এখনো গ্রামীণ জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এটি একদিকে কৃষকের উৎপাদনের অংশ, অন্যদিকে পশুপালনের অবলম্বন। একই সঙ্গে এটি বহন করে গ্রামীণ স্মৃতি ও জীবনের ইতিহাস। পৌষের শেষে জমি আবার চাষ হবে। নাড়া মিশে যাবে মাটির সাথে। মাঠে উঠবে নতুন ফসল। তবু মাঠে পড়ে থাকা এই নাড়া মনে করিয়ে দেবে কৃষি আর স্মৃতির সহাবস্থানের গল্প। যা সময়ের সাথে বদলালেও পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। এসইউ