ইন্দিরা থেকে খালেদা: দক্ষিণ এশিয়ার নারী শাসকদের উত্থান-পতন

ইতিহাসজুড়ে প্রায় ৯০-১০০ জনের কাছাকাছি নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে এসেছেন। তবে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় নারী নেতৃত্বের ইতিহাস আশ্চর্যজনকভাবে সমৃদ্ধ। যে অঞ্চলকে প্রথাগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক বলা হয়, সেখানে স্বাধীনতার পর থেকেই একের পর এক নারী উঠে এসেছেন দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বে। কেউ রাজবংশের উত্তরাধিকার হিসেবে, কেউ সংগ্রাম আর ত্যাগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয়ে। প্রাচীনকালে সুমেরের রানী কুবাবা, মিশরের ফারাও হাতশেপসুত, মিশরের শেষ ফারাও ক্লিওপেট্রা থেকে শুরু করে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, বাংলাদেশের খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো থেকে শ্রীলঙ্কার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা-তাদের জীবনকথা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে একদিকে যেমন শক্তি ও দৃঢ়তার প্রতীক, অন্যদিকে আছে চড়াই-উতরাই, বিতর্ক, এমনকি ট্র্যাজেডির ছোঁয়াও। সুমেরের রানী কুবাবা: বিশ্বের প্রথম স্বীকৃত নারী শাসকদের একজনসুমেরের রানী কুবাবা (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ) ছিলেন বিশ্বের প্রথম স্বীকৃত নারী শাসকদের একজন। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি কিশ নগররাষ্ট্র শাসন করেন। তার সময়ে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির কথা কিংবদন্তিতে পাওয়া যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হয়েও তিনি কার্যকর প্রশাসন পরিচালনা করেন যা পরবর্তী সময়ে তাকে এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ক্লিওপেট্রা: রূপ-বুদ্ধিমত্তা সব দিক থেকে এগিয়েঅন্যদিকে ক্লিওপেট্রা সপ্তম ছিলেন প্রাচীন মিশরের শেষ ফারাও (খ্রিস্টপূর্ব ৫১-৩০)। বুদ্ধিমত্তা, কূটনীতি ও ভাষাজ্ঞানের জন্য তিনি বিখ্যাত। জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে জোট তৈরি করে রোমের প্রভাব মোকাবিলার চেষ্টা করেন। কিন্তু অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে পরাজয়ের পর তার সাম্রাজ্য রোমের অধীনে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ইতিহাসে তিনি শক্তিশালী, কৌশলী এবং ট্র্যাজিক এক নারী শাসক হিসেবে স্মরণীয়। ইন্দিরা গান্ধী: ‘আয়রন লেডি’র উত্থান ও বিতর্কস্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেতৃত্বের প্রতীকী নাম। ১৯৬৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলে শুরু হয় তার রাজনৈতিক উত্থান। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, সিদ্ধান্তে আপসহীন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এক নেতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। লাখো শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ সবকিছু মিলিয়ে ইন্দিরা গান্ধী পরিণত হন এক প্রভাবশালী বৈশ্বিক নেতায়। তবে তার নেতৃত্ব ছিল বিতর্কহীন নয়। ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নাগরিক অধিকার সীমিত করা, রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের অভিযোগ তাকে স্বৈরশাসকের আসনে বসিয়েছিল। আবার ১৯৮৪ সালে শিখ বিদ্রোহ দমনে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত তার চরম জনপ্রিয়তা ও তীব্র সমালোচনা দুই-ই বয়ে আনে। সেই সিদ্ধান্তের প্রতিশোধেই তার দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু হয়। ইন্দিরা গান্ধীর জীবন যেন এক নাটকীয় রাজনৈতিক মহাকাব্য যেখানে নারীর নেতৃত্ব যেমন শক্ত হাতে ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে, তেমনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায়ও শেষ পর্যন্ত তাকেই নিতে হয়। বেনজির ভুট্টো: আশা, প্রতিরোধ ও ট্র্যাজেডিপাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় নারী নেতৃত্বের এক আলাদা অধ্যায়। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তার উত্থান, নির্বাসন ও কারাবাসের অভিজ্ঞতা তাকে জনতার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। ১৯৮৮ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক নারী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিরল সম্মান পান তিনি।বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হলেও, তার সরকার দুর্নীতির অভিযোগে বারবার বিতর্কে জড়ায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিধ্বংসী প্রচারণা, সেনাবাহিনীর প্রভাব, ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান সব মিলিয়ে তার রাজনৈতিক পথ কখনোই সহজ ছিল না। ২০০৭ সালে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে ফেরার পর জনসভায় আত্মঘাতী হামলায় তার মৃত্যু পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে। বেনজির দেখিয়ে গেছেন নারী হয়েও বড় রাজনৈতিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া যায়, কিন্তু একইসঙ্গে এ অঞ্চল কতটা ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক মঞ্চ, তারও নির্মম স্মারক তিনি। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা: গৃহযুদ্ধের ছায়ায় নেতৃত্বশ্রীলঙ্কার প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার উত্থানও পারিবারিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা থেকে। তার মা সিরিমাভো বন্দরানায়েকে ছিলেন বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। চন্দ্রিকার শাসনামলে একদিকে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, অন্যদিকে তামিল বিদ্রোহীদের সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধের বাস্তবতায় তাকে নিতে হয়েছে কঠিন সিদ্ধান্ত। আত্মঘাতী হামলায় এক চোখ হারিয়েও তিনি রাজনীতি ছাড়েননি এই দৃঢ়তাই তার নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। তবে শ্রীলঙ্কার জটিল জাতিগত সমস্যার সমাধান তার হাতেও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। তারপরও তিনি নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া: একই দেশের দুই ধ্রুব বিপরীতবাংলাদেশের রাজনীতি নারী নেতৃত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলোর একটি। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই দুই নেত্রী প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে।বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। সামরিক শাসনের অবসানের পর গণতন্ত্রের পুনরায় যাত্রায় তার ভূমিকা আলোচিত। আবার শিক্ষাখাতের বিস্তার, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে নীতিগত পদক্ষেপও ছিল তার সময়ের কাজের অংশ। তবে তার সরকারের বিরুদ্ধে দলীয়করণ, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগও উঠে এসেছে। পরবর্তীতে মামলায় কারাবাস ও রাজনীতি থেকে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তার রাজনৈতিক জীবন নাটকীয় মোড় নেয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন, এরপর ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো রূপান্তর, ডিজিটালাইজেশনসহ নানা ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে সমর্থকেরা দাবি করেন। আবার মানবাধিকার, গণতন্ত্রচর্চা, বিরোধী দলের দমন, মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা-এসব বিষয়ে সমালোচনাও রয়েছে ব্যাপকভাবে। সবশেষ ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার আন্দোলনে তার শাসনামলের পতন ঘটে। এই দুই নেত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটা দ্বিমেরু কাঠামোয় গড়ে উঠেছে, যা দেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সামাজিক মনন সবকিছুর ওপর গভীর ছাপ ফেলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার নারী শাসকদের গল্প একদিকে অসাধারণ সাফল্যের, অন্যদিকে পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বন্দি সংগ্রামেরও। তাদের উত্থানে অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা ‘ডায়নাস্টি পলিটিক্স’ বড় ভূমিকা রেখেছে। ফলে সমালোচকেরা বলেন, এসব নেতৃত্ব নারীর রাজনৈতিক সক্ষমতার স্বীকৃতি নয়, বরং ক্ষমতাবান পরিবারগুলোর বংশগত প্রভাবের বহিঃপ্রকাশ।তবু সত্য হলো এই নারীরা দেশের সর্বোচ্চ পদে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যুদ্ধ-সংকট-গণতন্ত্র-উন্নয়ন সবক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ নারীও অন্তত কল্পনা করতে পেরেছে। রান্নাঘর বা সংসারের গণ্ডিই শেষ গন্তব্য নয়, রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব নেওয়া যায়। যারা ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন, তাদের অনেকেরই পতন ছিল আলোড়নমুখর- কেউ নিহত হয়েছেন রাজনৈতিক সহিংসতায়, কেউ হারিয়েছেন ক্ষমতা সামরিক শাসন বা বিচারিক প্রক্রিয়ায়, কেউবা জনসমর্থন ধরে রাখতে পারেননি। এ অঞ্চল এখনো রাজনৈতিক সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে পিছিয়ে। ফলে নারী শাসকরাও পুরুষদের মতোই দলীয় বিরোধ, ষড়যন্ত্র, সামরিক হস্তক্ষেপ, এমনকি আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন হয়েছেন। নেতৃত্বের আসনে বসে তাদেরও শিখতে হয়েছে ক্ষমতা যেমন সম্মানের, তেমনি তা ঝুঁকিরও নাম। প্রশ্ন হলো এই নারী শাসকরা কি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়নের নতুন দিগন্ত খুলেছেন? নাকি কেবল পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিরই আরেকটি রূপ? উত্তর হয়তো মাঝামাঝি কোথাও। তাদের নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নারী কোনো বিকল্প নন, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মূল চালিকাশক্তিও হতে পারেন। একই সঙ্গে এও পরিষ্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি পরিবারকেন্দ্রিক, ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং সংঘাতপ্রবণ থাকে, তবে নেতা নারী হোক বা পুরুষ গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রচালনায় অস্থিরতা থেকেই যাবে। তবু দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এই নারী নেত্রীরা এক অনন্য অধ্যায়। তাদের উত্থান একদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থানকে দৃশ্যমান করেছে, অন্যদিকে তাদের পতন মনে করিয়ে দেয় ক্ষমতা কখনো স্থায়ী নয়। ইন্দিরা থেকে খালেদা এই পথচলার গল্প তাই কেবল কয়েকজন নারীর ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও বাস্তবতার ইতিহাসও বটে। আরও পড়ুনবড়দিনের রাতে থেমে গিয়েছিল যুদ্ধআয়ু শেষ হলে জাহাজের ভাগ্যে কী ঘটে জানেন? কেএসকে