বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে চরম টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। দুই দলের প্রত্যাশিত আসন বণ্টন, এনসিপিকে একতরফাভাবে আসন দেওয়ার অভিযোগ এবং নতুন দল যুক্ত করা নিয়ে মতবিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। এসব বিষয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন দুই দলের নেতারা। জানা গেছে, জামায়াতসহ ৮ দলের সমঝোতায় নতুন তিনটি দল এনসিপি, এলডিপি ও এবি পার্টির প্রবেশের পর দুই দলের দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রকাশ্যে আসে। আসন বন্টনসহ নানা ইস্যুতে প্রকাশ্যে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ইসলামী আন্দোলন। এরই মাঝে সোমবার মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিনে ২৭২ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এছাড়া সমোঝতা ও নির্বাচনের নিয়ে দলের অবস্থান পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে দলটি। পরবর্তীতে মঙ্গলবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করে ইসলামী আন্দোলন। সারাদেশে তারা ১৪৩ আসনকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রেখেছে। অর্থাৎ ১৪৩ আসনে নিজেদের অবস্থান ভালো দেখছে দলটি। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে কম আসন প্রস্তাব করায় দলটির নেতারা অসন্তুষ্ট। এছাড়া যেসব এলাকায় চরমোনাই পীরের ভক্ত-অনুরাগী কিংবা সমর্থন বেশি সেসব আসনেও জামায়াত তাদের ছাড় দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারাদেশে তারা ১৪৩ আসনকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রেখেছে। অর্থাৎ ১৪৩ আসনে নিজেদের অবস্থান ভালো দেখছে দলটি। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে কম আসন প্রস্তাব করায় দলটির নেতারা অসন্তুষ্ট। এছাড়া যেসব এলাকায় চরমোনাই পীরের ভক্ত-অনুরাগী কিংবা সমর্থন বেশি সেসব আসনেও জামায়াত তাদের ছাড় দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও পড়ুনভর্তি পরীক্ষার জন্য জামায়াতের মহাসমাবেশ স্থগিতজামায়াতের সঙ্গে জোট, একে একে সরে যাচ্ছেন এনসিপি নেত্রীরাজামায়াতের সঙ্গে আরও একটি দল আসবে, হবে ১১ দলীয় জোট দলটির নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘এক বাক্স’ নীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য ইসলামী আন্দোলন বড় ঝুঁকি নিয়েছিল। বহু আলেম ও সমর্থকের আপত্তি সত্ত্বেও বৃহত্তর স্বার্থে তারা সেই পথে এগিয়েছিল। কিন্তু জামায়াত সেই সুযোগ নষ্ট করেছে। ইসলামী আন্দোলনের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ও আসন সমোঝতায় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য শেখ ফজলে বারী মাসউদ জাগো নিউজকে বলেন, জামায়াত এখনো স্পষ্ট করেনি তারা কতটি আসনে নির্বাচন করতে চায়। অথচ সমঝোতার জন্য এটা স্পষ্ট করা জরুরি। আমরা বুঝতে পারছি তারা নিজেরা চায় ২০০ আসনে নির্বাচন করতে, আর অন্যদের নামেমাত্র রাখবে। এটা সমঝোতা নয়। তারা ২০০ আসনে নির্বাচন করবে আর আমাদের ৩৫/৪০ আসন দেবে, আমাদের প্রাপ্য কি শুধু এতটুকুই? তিনি বলেন, আমাদের ঘাঁটি বরিশাল। বরিশাল জেলার ছয়টা আসনের মধ্যে তিনটা তারা (জামায়াত) চেয়ে বসে আছে। তারা আমাদের বরিশাল-৫ আসনেও মনোনয়ন তুলে আবার জমাও দিয়েছে। অথচ এটা আমাদের পীর শায়েখের আসন। আমাদের লিয়াজোঁ কমিটির মিটিং এ তারা এই আসন চেয়ে বসে আছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, সব ঠিকই আছে। তারা যে অভিযোগ করেছে এগুলো অফিসিয়ালি আমাদের কাছে আসেনি। এগুলো তাদের ব্যক্তিগত। অফিসিয়ালি তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, তাই এগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তিনি আরও বলেন, আমাদের সঙ্গে মাত্র তিন বিভাগ- ময়মনসিংহ, বরিশাল ও চট্টগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাকি ৫ বিভাগ নিয়ে জামায়াত কোনো আলোচনাই করেনি। চট্টগ্রামে বিভাগের ১৮ আসনে তারা মাত্র একটা কী দুইটা আসন আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখতে চায়। আর বাকি সবগুলোতে নিজেরা নির্বাচন করতে চায়। যে আসনে আমাদের ভালো অবস্থান সেটাও তারা দিচ্ছে না। এভাবে তো আর সমঝোতা হয় না। ইসলামী আন্দোলনের এ কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, রংপুর-রাজশাহী নিয়ে তারা কোনো আলোচনাই করতে রাজি না। এসব বিভাগে জামায়াতের বক্তব্য এরকম যে, আপনারা (চরমোনাই) এগুলো পাবেন না। অথচ কুড়িগ্রামে আমাদের বিশাল ইজতেমা হয়। সেখানে আমাদের সমর্থন অনেক। এখানেও নাকি সব আসন জামায়াতের লাগবে। পুরো রংপুর বিভাগটা তারা চায়। খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি। এনসিপি-এবি পার্টিকে নিয়ে জামায়াতের একক সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ফজলে বারী মাসউদ জাগো নিউজকে বলেন, জামায়াত জোটের অন্য শরিকদের পাশ কাটিয়ে নিজেদের মতো করে এনসিপি, এলডিপিসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। অথচ সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল যৌথভাবে। তারাতো জোটের একমাত্র সিদ্ধান্তদাতা নয়। কথা ছিল বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তিনি বলেন, শুরুতেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এনসিপিকে নিজেদের সঙ্গে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে তারা আর আসেনি। এখন শোনা যাচ্ছে, জামায়াত এককভাবে এনসিপির সঙ্গে আলোচনা করছে এবং ৩০টি আসনের প্রস্তাব দিয়েছে। বিষয়টি আমাদের কাছে স্বস্তিকর নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা চেয়েছিলাম সবাই একসঙ্গে আন্দোলনে থাকুক, সেটা হয়নি। এখন এনসিপিকে নেওয়া হচ্ছে—এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা হতে হবে জোটের শীর্ষ নেতাদের আলোচনার ভিত্তিতে। জামায়াত এককভাবে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় না। সমঝোতা নিয়ে গড়িমসির অভিযোগ এদিকে জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলনের ভেতরের একটা অংশ চাচ্ছে জামায়াতকে চাপে রেখে বাড়তি কিছু আসন নিতে বা যত আসন নেওয়া যায়। তাদের কেউ কেউ পৃথক নির্বাচনেরও দাবি তুলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামী আন্দোলনের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, তফসিল ঘোষণার আগেই আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়া দরকার ছিল। ইসলামী আন্দোলন এ বিষয়ে আন্তরিক ছিল এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু জামায়াত পরিকল্পিতভাবে সময়ক্ষেপণ করেছে। ৯ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে মাত্র দুই দফা বৈঠক হয়েছে, তাও খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। এতে বোঝা যায় তারা প্রকৃত অর্থে সমঝোতা চায় না। তিনি বলেন, বিএনপিসহ অন্য দলগুলো এরইমধ্যে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। কিন্তু জামায়াত এখনো আসন সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতা রেখে দিয়েছে। এই দ্বন্দ্ব মূলত জামায়াতের সঙ্গেই। অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিষয়গুলো প্রায় পরিষ্কার। তিনি বলেন, এই সময়ক্ষেপণের কারণে আমাদের বড় ক্ষতি হয়েছে। আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে পারতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছি। চরমোনাই পীরের ঘনিষ্ঠ এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বলেন, জামায়াতের পক্ষ থেকে আগেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে যে তারা কম আসনে নির্বাচন করেছে। কিন্তু জামায়াত ও বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি ও ভোটব্যাংক তো এক নয়। জামায়াত কখনোই একা ক্ষমতায় যাননি, অথচ এখন তারা বড় ভাই সেজে বসে আছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, জামায়াতের ইতিহাস বলে, তারা কখনো সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এবারও তারা সেটাই প্রমাণ করছে। এদিকে জামায়াত ইসলামী জানিয়েছে, গতকাল সারাদেশে ২০০ আসনে কিংবা তার একটু বেশি আসনে তারা মনোনয়ন দাখিল করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়েরকে সমঝোতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, সব ঠিকই আছে। তারা যে অভিযোগ করেছে এগুলো অফিসিয়ালি আমাদের কাছে আসেনি। এগুলো তাদের ব্যক্তিগত। অফিসিয়ালি তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, তাই এগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’ এখনো আশাবাদী দুই দল ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ ফজলে বারী মাসউদ বলেন, এখনো দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তারা (জামায়াত) যদি সম্মানজনক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সমঝোতায় আসতে চায়, আমরা প্রস্তুত। কিন্তু তাদের জন্য আমরা বসে বসে অপেক্ষা করবো না। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম জাগো নিউজকে বলেন, দুই দলের মধ্যে আলোচনা চলমান। সমঝোতায় কিছু চ্যালেঞ্জ স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। আরএএস/এসএইচএস/এএসএম