কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে রয়েছে একাধিক নিরাপত্তা ত্রুটি। এসব ত্রুটির মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করছেন পর্যটকরা।সম্প্রতি সেন্টমার্টিনগামী একটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর প্রশাসনের টনক নড়ে। যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিতে যৌথ অভিযানে জাহাজে নানা ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কোস্টগার্ড। তবে পর্যটকদের দাবি-নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।নীল সমুদ্র আর প্রবাল দ্বীপের টানে প্রতিদিন শত শত পর্যটকের যাত্রা কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের পথে। কিন্তু আনন্দের এই ভ্রমণেই লুকিয়ে আছে বড় ঝুঁকি।কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী বেশ কয়েকটি জাহাজে রয়েছে একাধিক নিরাপত্তা ত্রুটি। যেমন লাইফ জ্যাকেটের বেহাল অবস্থা, নেই জাহাজের প্রধান মাস্টার। আবার সহকারী মাস্টারের নেই অভিজ্ঞতা, নেই জাহাজের ইঞ্জিনের রুমের ব্যবস্থাপনা।সম্প্রতি সেন্টমার্টিনগামী একটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের মধ্যে। এই ঘটনার পরই টনক নড়ে প্রশাসনের। মঙ্গলবার ভোররাতে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যৌথ অভিযানে জাহাজগুলোতে নানা ত্রুটি শনাক্ত করা হয়।আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের আগুনে ঘুমন্ত ক্রুর মৃত্যু, তদন্ত কমিটি গঠনকক্সবাজারস্থ বিআইডব্লিউটিএ নদী বন্দর কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াকিল বলেন, ‘পরিদর্শনকালে আমরা প্রায় সব জাহাজেই একটি সাধারণ ও গুরুতর ত্রুটি লক্ষ্য করেছি। জাহাজের সনদপত্র অনুযায়ী যে যোগ্য প্রথম শ্রেণীর মাস্টার থাকার কথা, অনেক জাহাজেই তাকে পাওয়া যায়নি। বরং দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় শ্রেণীর মাস্টার বা সহকারী মাস্টার দিয়েই জাহাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।’তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে এ পরিস্থিতি চলমান। জাহাজ মালিক পক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে দ্রুতই যোগ্য মূল মাস্টার সরবরাহ করা হবে, তবে বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়নি।পরিদর্শনে ইঞ্জিন রুম সংক্রান্ত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি ধরা পড়ে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন ইঞ্জিনের প্রেসার ও কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে মেইনটেনেন্স লগবুক সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ জাহাজেই এই লগবুক সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি।’তিনি আরও বলেন, ‘বে ক্রুজ ইন্টারন্যাশনাল ওয়ান’ নামের জাহাজটিতে বেশ কিছু গুরুতর ত্রুটি পাওয়া গেছে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাস্টার ছিলেন একজন সহকারী মাস্টার, যিনি জাহাজের ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ জরুরি সরঞ্জামের অবস্থান সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ওই ব্যক্তি পূর্বে ওয়েল ট্যাঙ্কারে কাজ করলেও যাত্রীবাহী জাহাজ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তিনি এর আগে কখনো প্যাসেঞ্জার শিপে কাজ করেননি।মো. আব্দুল ওয়াকিল বলেন, এমন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির ওপর যাত্রীবাহী জাহাজের দায়িত্ব দেওয়া-বিশেষ করে সেন্টমার্টিনের মতো সমুদ্রগামী রুটে, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত। জাহাজ মালিক পক্ষের উচিত ছিল নিয়োগের আগে যথাযথ যাচাই-বাছাই করে সমুদ্রগামী বড় প্যাসেঞ্জার শিপ পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ মাস্টার নিয়োগ দেওয়া।আর জাহাজগুলোর ত্রুটিসমূহ তদন্ত আকারে উপস্থাপনের পর জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।আরও পড়ুন: হাড়কাঁপানো শীতেও লোকে লোকারণ্য কক্সবাজার, হোটেল ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণঅভিযানে নেতৃত্বদানকারী কোস্টগার্ড কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সালাহউদ্দিন রশিদ তানভীর বলেন, সম্প্রতি ক্রু সংকট ও অনভিজ্ঞতার কারণে সেন্টমার্টিনগামী ‘দ্যা আটলান্টিক ক্রুজ’ ও ‘এমভি কর্নফুলী এক্সপ্রেস’ জাহাজ চরে আটকে পড়া এবং ২৭ ডিসেম্বর ‘দ্যা আটলান্টিক ক্রুজ’-এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পর্যটকদের জান-মালের নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে, যা দেশের পর্যটন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।তিনি বলেন, মঙ্গলবার ভোররাত সাড়ে ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কোস্টগার্ড, জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ-এর সমন্বয়ে কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে পর্যটকবাহী জাহাজসমূহে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে জাহাজের রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ক্রুদের দক্ষতা সনদ যাচাই করা হয়।লে. কমান্ডার তানভীর আরও বলেন, অভিযানে যাত্রী তালিকা, নির্ধারিত ধারণক্ষমতা অনুসরণ, পর্যাপ্ত লাইফ সেভিং ইকুইপমেন্ট ও ক্রুদের দায়িত্বশীলতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পরিদর্শনে পাওয়া ত্রুটিগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তদন্ত প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হবে এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পর্যটকদের অভিযোগ, কাগজে-কলমে আশ্বাস নয়, বাস্তবেই নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হবে।সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের যাত্রী রিশাদ বলেন, বর্তমানে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে যে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান না করে, তাহলে এটি আমাদের সবার জন্যই বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে। আরেক পর্যটক ফরিদুল আলম বলেন, আমরা অবশ্যই ত্রুটিমুক্ত জাহাজে সেন্টমার্টিন যাতায়াত করতে চাই। তবে সেটি হতে হবে নিরাপদ ভ্রমণ। পর্যটকরা যেন নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারেন এবং দেশের পর্যটন খাত আরও ভালোভাবে বিকশিত হয়-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে আগুনে কর্মচারী নিহত, জীবিত উদ্ধার ১৫সেন্টমার্টিনগামী পর্যটক মুজিবুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিনে যাত্রা যেন নিরাপদভাবে সম্পন্ন হয়-নিরাপদে পৌঁছানো ও নিরাপদে ফিরে আসা নিশ্চিত করা হোক। পাশাপাশি পুরো ব্যবস্থাপনাকে আরও সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমাদের এই আহ্বান। সেন্টমার্টিন ভ্রমণ যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে নিরাপত্তা অবহেলার কারণে। পর্যটকদের দাবি-দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।