খালেদা জিয়া: ভয় ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে দেশপ্রেমের এক অনন্য উপাখ্যান

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কিছু মানুষের নাম কেবল কালির অক্ষরে নয়, বরং আদর্শের মূর্ত প্রতীক হিসেবে খোদাই করা থাকে। বেগম খালেদা জিয়া সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হিসেবে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পথ দেখিয়েছেন। তার মৃত্যুতে কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অভিভাবকের প্রস্থান ঘটেনি, বরং অবসান ঘটেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ধৈর্যশীল এবং আপসহীন এক অধ্যায়ের।বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে বেগম জিয়া ছিলেন এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, যার আলোয় পথ খুঁজে পেয়েছে কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষ। আমাদের জাতীয় চরিত্রে দুটি গুণের বড় অভাব- ভয়কে জয় করা আর প্রলোভনকে তুচ্ছ করা। যেখানে সামান্য ক্ষমতার মোহে আদর্শ বিসর্জন দেওয়া আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বেগম জিয়া ছিলেন এক অবিচল পাহাড়। তিনি কেবল একটি দলের নেত্রী ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং আপসহীনতার জীবন্ত পোস্টার।১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা খানম পুতুলের জীবন ছিল শান্ত ও নিভৃতচারী। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি একনিষ্ঠভাবে সংসার সামলেছেন। স্বামীর কর্মস্থল থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক-বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়া, সবকিছুই তিনি সয়েছেন অসীম ধৈর্যে। স্বাধীনতার পর তিনি ছিলেন নিভৃতচারী এক ফার্স্ট লেডি। ক্ষমতার মোহ তাকে স্পর্শ করেনি কখনো।কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্রগ্রাম সার্কিট হাউসে এক বিয়োগান্তক ঘটনায় জীবন বদলে যায় তার। স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকস্মিক শাহাদাতে যখন দেশ ও দল দিশেহারা, তখন দলের অস্তিত্ব রক্ষায় নেতা-কর্মীদের দাবিতে তিনি রাজনীতির ময়দানে নামতে বাধ্য হন। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় তার সেই যাত্রা, যা তাকে পরবর্তীতে ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে অগ্নিপরীক্ষা ছিল আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। ৯ বছরের সেই দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি রাজপথ ছাড়েননি একদিনের জন্যও। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যখন অনেক বড় বড় নেতা নানা কৌশলে সমঝোতা করেছেন, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়। তাকে বারবার গৃহবন্দি করা হয়েছে, হয়রানি করা হয়েছে, কিন্তু তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায়নি।১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার যে সাহসী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন, তা ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক মাস্টারস্ট্রোক। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, জনগণের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া মানে স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়া। ১৯৯০ সালের সেই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে তার নেতৃত্বই ছিল চূড়ান্ত আঘাত। পতন ঘটে স্বৈরশাহীর, আর সূচিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্রের নতুন পথ। সেই থেকেই তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’।১৯৯১ সালের ৫ মে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তার শাসনকাল ছিল আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি রচনার সময়। মেয়েদের মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু ছিল তার সবচেয়ে বড় সাফল্য। আজ বাংলাদেশের নারীরা যে উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সুফল ভোগ করছে, তার বীজ বপন করেছিলেন তিনি। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। তার সময়েই ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, যা দেশের রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করে। যমুনা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পের কাজ তার হাত ধরেই গতি পায়। এছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন।২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যখন দেশে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন বেগম জিয়ার সামনে ছিল দুটি পথ- হয় দেশত্যাগ করা, নয়তো কারাবরণ। তৎকালীন কুশীলবরা তাকে রাজকীয় প্রলোভন দেখিয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, দেশ ছেড়ে চলে গেলে সব মামলা তুলে নেওয়া হবে এবং বিদেশে বিলাসী জীবনের ব্যবস্থা করা হবে।আরও পড়ুন: দুর্লভ ছবিতে গৃহবধূ থেকে সংগ্রামী বেগম খালেদা জিয়াকিন্তু খালেদা জিয়া ছিলেন অন্য ধাতুর তৈরি। তিনি গর্জে উঠে বলেছিলেন, 'বিদেশে আমার কোনো ঘর নেই, এই দেশই আমার সব। আমি যদি মরি তবে এই দেশেই মরব।' তার এই একটি উক্তি তৎকালীন ষড়যন্ত্রকারীদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি তার দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে নির্যাতিত হতে দেখেছেন, তবুও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মুক্তির পথ বেছে নেননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, পরিবারের মায়ার চেয়ে দেশের মাটির টান তার কাছে অনেক বেশি।আমাদের প্রাত্যহিক দৃশ্য হলো সামান্য লাভের জন্য আদর্শ বিক্রি করা। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে প্রলোভন ছিল নিত্যদিনের বিষয়। তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বহুবার টোপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা বা সম্পদের মোহ তাকে কখনো পথচ্যুত করতে পারেনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তার দীর্ঘ লালিত জাতীয়তাবাদী দর্শন থেকে একচুলও নড়েননি।তার সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যুতে এক শোকাতুর মা হিসেবে তিনি যখন ভেঙে পড়েছিলেন, তখনও তার রাজনৈতিক অবস্থান ছিল পাহাড়ের মতো অটল। তিনি তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিকে কখনো জাতীয় স্বার্থের সাথে গুলিয়ে ফেলেননি। সম্পদের প্রতি তার অনীহা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেখানে পৌঁছানো যেকোনো রাজনীতিকের জন্য স্বপ্নের মতো।২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এক বয়োজ্যেষ্ঠ নেত্রীকে যখন কারারুদ্ধ করা হয়, তখন সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। জরাজীর্ণ জেলখানা, একাকীত্ব আর গুরুতর অসুস্থতা তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু এই প্রতিকূল পরিবেশেও তার মেরুদণ্ড ছিল ঋজু।অসুস্থ শরীরে যখন তিনি হাসপাতালের বিছানায় ধুঁকছিলেন, তখনও তার মুখে ছিল সেই একই তেজ। তিনি জানতেন, সামান্য একটি সমঝোতা করলে বা তথাকথিত ‘ক্ষমা’ চাইলে তিনি মুক্তি পেতে পারতেন, বিদেশে উন্নত চিকিৎসা পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি জেল জুলুমকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন, তবুও আপস করেননি। তার এই দৃঢ়তা আমাদের শেখায় যে, ভয়কে জয় করতে জানলে পরাজয়ও গৌরবের হয়ে ওঠে।আরও পড়ুন: ‘এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা’, ১/১১ এর সময় বলেছিলেন খালেদা জিয়াবেগম খালেদা জিয়ার ত্যাগের কথা বলতে গেলে তার পারিবারিক বিচ্ছেদের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি তার বড় সন্তান তারেক রহমানকে দেখতে পাননি। ছোট ছেলে কোকোর লাশ যখন দেশে এলো, তখন তিনি অবরুদ্ধ। একজন মায়ের জন্য এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? তবুও তিনি অবিচল।তিনি তার ব্যক্তিগত সুখ, শান্তি আর আভিজাত্য বিসর্জন দিয়েছেন কেবল দেশের গণতন্ত্রের জন্য। তার ত্যাগের পরিধি এতটাই বিশাল যে, তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি দেখিয়ে গেছেন, নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতা ভোগ করা নয়, নেতৃত্ব মানে ত্যাগের চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করা।খালেদা জিয়া আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ লক্ষ-কোটি তরুণের পাথেয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাকে কেন এত ভালোবাসত? কারণ তারা দেখত, তাদের নেত্রী তাদেরই মতো একজন, যিনি কোনো চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন না। তিনি ছিলেন গ্রাম-বাংলার মানুষের অতি আপনজন। তার ‘ধানের শীষ’ কেবল একটি প্রতীক ছিল না, ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।বেগম খালেদা জিয়ার বিদায় মানে কেবল একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং একটি জীবন্ত প্রতিষ্ঠানের প্রস্থান। বাঙালির মাঝে যে সাহসের অভাব ছিল, তিনি তা পূরণ করে গেছেন। যে প্রলোভনের মোহে আমরা বারবার পথ হারাই, তিনি দেখিয়ে গেছেন কীভাবে সেই মোহকে তুচ্ছ করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়।তিনি আজীবন লড়েছেন কখনো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, কখনো বিজাতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে, আবার কখনো নিজের শরীরের হাজারো রোগের বিরুদ্ধে। কিন্তু হারেননি। মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সংগ্রামী চেতনাকে পরাজিত করতে পারেনি।বাংলাদেশের প্রতিটি সবুজ প্রান্তরে, প্রতিটি মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে খালেদা জিয়ার নাম ধ্বনিত হবে চিরকাল। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন এক অজেয় হিমালয়সম আদর্শ। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এই আপসহীন নেত্রীর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।বিদায়, গণতন্ত্রের মানসকন্যা। বিদায়, দেশনেত্রী। আপনার ঋণ এ জাতি কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।