চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় কনকনে শীতের মধ্যে সড়কের পাশে উদ্ধার হওয়া অসুস্থ দুই শিশুর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে শিশু দুটির চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন।উদ্ধার হওয়া শিশুদের মধ্যে চার বছর বয়সী মেয়ে শিশুটির নাম আয়েশা এবং দুই বছর বয়সী ছেলে শিশুটির নাম মোরশেদ।মেয়ে শিশুটি জানায়, তাদের বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার মৌলভীর দোকান এলাকায়। তাদের বাবা খোরশেদ আলম এবং মা ঝিনুক আখতার।জানা গেছে, শিশু দুটির করুণ অবস্থার খবর প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরে আসলে জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিকভাবে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আক্তারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার শিশু দুটিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আনা হয়।জাতীয় নির্বাচনের ব্যস্ততার মধ্যেও জেলা প্রশাসক দীর্ঘ সময় ধরে শিশুদের শারীরিক অবস্থা, পারিবারিক পরিচয়, উদ্ধারের প্রেক্ষাপট এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেন। বিশেষ করে ছেলে শিশু মোরশেদের শারীরিক দুর্বলতা ও অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় ও প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাতে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেন জেলা প্রশাসক।আরও পড়ুন: বাবা-মায়ের খোঁজ নেন না প্রবাসী ছেলেরা, পাশে দাঁড়ালেন ইউএনওতিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, যেন শিশুদের চিকিৎসা ও পরিচর্যায় কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকে।এছাড়া শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক।উল্লেখ্য, রোববার সন্ধ্যায় আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের মাজারগেট এলাকায় কনকনে শীতের মধ্যে সড়কের পাশে বসে থাকা অবস্থায় স্থানীয় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মহিম উদ্দিন শিশু দুটিকে উদ্ধার করেন।মহিম উদ্দিনের স্ত্রী শারমিন আক্তার জানান, দুই শিশুই অসুস্থ ছিল এবং ছোট শিশুটি প্রতিবন্ধী। রাতে গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে ও খাবার খাওয়ানোর পর তারা কিছুটা স্বস্তি পায়। তার ধারণা, শিশুদের অসুস্থতার কারণেই মা–বাবা তাদের ফেলে রেখে গেছেন।বিষয়টি স্থানীয়দের মাধ্যমে প্রশাসনের নজরে এলে জেলা প্রশাসনের তৎপরতায় শিশু দুটির চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়।মানবিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শিশু দুটিকে উদ্ধারকারী সিএনজিচালক মহিম উদ্দিনকে নগদ ১০ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করেন জেলা প্রশাসক।এ বিষয়ে মহিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি পুরস্কারের আশায় শিশু দুটিকে উদ্ধার করিনি। মানবিক কারণেই তাদের উদ্ধার করেছি। তবে ডিসি স্যারের এই উৎসাহ আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে।’তিনি জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতার প্রশংসা করে বলেন, ‘অসহায় শিশুদের প্রতি তার আচরণ প্রমাণ করে, তিনি সত্যিই একজন মানবিক ডিসি।’স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য সাফায়েত শিহাব বলেন, ‘ডিসি স্যারকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছে তিনি খুবই অমায়িক ও মানবিক মানুষ। শিশু দুটির জন্য তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সব ব্যবস্থা নিয়েছেন।’ডিসি জাহিদুল ইসলামের ভূয়সী প্রশংসা করে স্থানীয় নারী সদস্য আফরোজা খানম বলেন, ‘ডিসি স্যার অত্যন্ত ভালো মানুষ। উদ্ধার পরবর্তী কাজে আমাদের সহযোগিতার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তার ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করেছে। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন মানবিক ডিসি।’উদ্ধার পরবর্তী কার্যক্রমে অংশ নেয়া আনোয়ারা থানার উপপরিদর্শক মোমেন কান্তি দে বলেন, ‘শিশু দুটির প্রতি জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। ভালো কাজ যিনি করেন, তাকে মানবিক বলতেই হয়।’আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘ডিসি স্যারের নির্দেশনায় শিশু মোরশেদকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে শিশুটির জন্য সার্বক্ষণিক একজন নার্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুস্থ হলে সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে তাকে সেইভ হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’আরও পড়ুন: কটিয়াদীতে প্রতিবন্ধী খুরশিদ মাঝির জীবনযুদ্ধে পাশে দাঁড়ালেন ইউএনওতিনি আরও বলেন, ‘ডিসি স্যার মানবিক কাজকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। চিকিৎসা সহায়তা থেকে শুরু করে যেকোনো মানবিক উদ্যোগে তিনি সবসময় সক্রিয়। তাকে নিঃসন্দেহে মানবিক ডিসি বলা যায়।’এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘শিশু দুটিকে একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশে লালন-পালন এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিজের সন্তানকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু যে মানুষটি নিজের সন্তানের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যের সন্তানকেও আপন করে নিতে পারে, তারাই প্রকৃত অর্থে মানুষ। অন্যের সন্তানের প্রতি ভালবাসাইতো প্রকৃত মানবতা।’